লক্ষ্মীপ্যাঁচা গেয়ে গেছে গান

লক্ষ্মীপ্যাঁচা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
ছবি: দিলীপ দাশ বিসর্গ

‘পৃথিবীর পথে যদি থাকিতাম বেঁচে

দেখিতাম সেই লক্ষ্মীপেঁচাটির মুখ যারে কোনোদিন ভালো ক’রে দেখি নাই আমি—¾

এমনি লাজুক পাখি,—ধূসর ডানা কি তার কুয়াশার ঢেউয়ে ওঠে নেচে;’

—জীবনানন্দ দাশ

ঢাকা শহরে রাত একটু গভীর হলে, যখন যানবাহনের শব্দ কমে আসে, তখন এক পাখির হিসহিস শব্দের ডাক শোনা যায়। অন্ধকার ও কৃত্রিম আলোয় দেখা যায় সোনালি-সাদা পালকের সেই পাখির ওড়াওড়ি। ঢাকার আবাসিক ও বৃক্ষময় এলাকায় পাখিটির বিচরণ প্রতিরাতেই চোখে পড়ে। দিনের আলোয় কোনো দিন দেখা হয়নি সেই পাখির সঙ্গে। দেখেছি শুধুই রাতের আঁধারে। গভীর রাতে শুনেছি, শহরের বাতাসে ভেসে আসা সেই পাখির ডাক। অমর একুশের রাতে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সময় কেটেছে, তখন দেখেছি তাদের উড়ে চলা, চালচলন। গ্রামের কোনো বনে কখনোই চোখে পড়েনি ছেলেবেলায়, শুনেছি শুধু তার ডাকাডাকি রাতের বেলায়!

লক্ষ্মীপ্যাঁচা প্রধানত ইঁদুর খায়। তা ছাড়া ছোট পাখি ও ছোট বাদুড়ও খায়। লক্ষ্মীপ্যাঁচা (Tyto alba) কখনো দিনের বেলায়ও ওড়ে। মূলত বিপদে পড়লে বা থাকার জায়গা পরিবর্তনের জন্য এ পাখি এমনটি করে।

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বলেছেন, তিনিও এ পাখির মুখ কোনো দিন দেখেননি ভালো করে, দেখেছেন পাখিটির ধূসর ডানা। তিনি শুনেছেন তার গান কদমের ডালে, যেমন—‘কদমের ডালে আমি শুনেছি যে লক্ষ্মীপেঁচা গেয়ে গেছে গান/নিশুতি জ্যোৎস্না রাতে।’

লক্ষ্মীপ্যাঁচা নিশাচর পাখি। দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে কোনো গাছের পাতার আড়ালে বা কোটরে। কিংবা শহরের ইমারতের কোনো ফোকরে। শহরে রাত একটু গভীর হলেই লক্ষ্মীপ্যাঁচার ওড়াওড়ি চোখে পড়ে, ডাক শোনা যায়। শহরের বাড়ির ছাদে কিংবা বাগানের প্রান্তে ইঁদুর ধরার জন্য বসে থাকে লক্ষ্মীপ্যাঁচা। ভোররাত অবধি থাকে তাদের ব্যস্ততা। তারপর আলো এলেই লুকিয়ে পড়ে। শহরে লক্ষ্মীপ্যাঁচার দেখা সহজ বটে; কিন্তু গ্রামে দেখা পাওয়া মুশকিল। তবে কোনো পুরোনো বা পরিত্যক্ত বাড়িতে মাঝে মধে৵ দেখা মেলে।

লক্ষ্মীপ্যাঁচা লাজুক স্বভাবের পাখি। গ্রাম, শহর, পোড়ো বাড়ি ও গুহায় এই পাখি বাস করে। সচরাচর একা, জোড়ায় বা পারিবারিকভাবে দলে চলে। গাছের কোটর ও ছাদের কার্নিশে বাসা বানিয়ে ডিম দেয়। ডিম সাদা, চার থেকে সাতটি। স্ত্রী পাখি একা ডিমে তা দেয়। প্রায় ৩৪ দিনে ডিম ফুটে ছানা বের হয়। বাকি কাজ দুজন মিলেই করে। অ্যান্টার্কটিকা বাদে পৃথিবীর সব মহাদেশে এ পাখির বিচরণ রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মালদ্বীপ ছাড়া সব দেশেই দেখা যায়।

বাংলাদেশে এটি দুর্লভ আবাসিক পাখি। লক্ষ্মীপ্যাঁচা প্রধানত ইঁদুর খায়। তা ছাড়া ছোট পাখি ও ছোট বাদুড়ও খায়। লক্ষ্মীপ্যাঁচা (Tyto alba) কখনো দিনের বেলায়ও ওড়ে। মূলত বিপদে পড়লে বা থাকার জায়গা পরিবর্তনের জন্য এ পাখি এমনটি করে। তবে শহরের পাতিকাক দিনের বেলায় লক্ষ্মীপ্যাঁচা দেখলে দলবদ্ধভাবে একে বিরক্ত করে। আহত করে ঠুকরে।

লক্ষ্মীপ্যাঁচা বড় আকারের পাখি। এগুলোর দৈর্ঘ্য ৩৬ সেমি। ডানার পালক ফ্যাকাশে ধূসর ও সোনালি। মুখের পালক ধবধবে সাদা। পুরুষ ও স্ত্রী পাখি দেখতে অভিন্ন। সারা বিশ্বে লক্ষ্মীপ্যাঁচার ২৮টি উপপ্রজাতি রয়েছে। ইঁদুর খেয়ে এই পাখি প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।

সৌরভ মাহমুদ, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক