শব্দদূষণের শহরে বসবাস

৩০ মিনিট পরই গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। ব্যবসায়ী মাসুদ আলমের দ্রুত কারওয়ান বাজার থেকে গুলশান যেতে হবে। তাই নিজের গাড়িতে না গিয়ে ভাড়ায়চালিত বাইকে উঠে বসলেন তিনি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাকে ঠিকই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিল বাইকচালক। কিন্তু মিটিং করার মতো মানসিক অবস্থা ততক্ষণে নষ্ট হয়ে গেছে মাসুদ আলমের। কারণটা শুনুন তার মুখেই, ‘বাইকের চালক অকারণে হর্ন বাজাতে বাজাতে আমাকে গুলশান পৌঁছে দিল। যেখানে হর্ন বাজানোর দরকার নেই, যেমন সিগন্যালে তিনি হর্ন বাজিয়েছেন। হর্ন বাজানোর ধরন দেখে মনে হচ্ছিল হর্ন দিলেই সিগন্যাল ছেড়ে দেবে এবং বাইক চলা শুরু করবে। হর্নের তীব্রতায় মাথাব্যথা করছে। মিটিংয়ে যোগ দেওয়াই এখন কঠিন হয়ে গেছে।’

শুধু মাসুদ আলম একাই নয়, ঢাকা শহরে বসবাসরত এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি অহেতুক হর্ন বাজানোর কারণে বিরক্ত হননি। এই নীরব ঘাতকের সরব ছোবলে অতিষ্ট নগরবাসী।

সম্প্রতি জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের পর এবার শব্দদূষণেও বিশ্বের শীর্ষ স্থানটি দখল করছে ঢাকা। শব্দদূষণে ঢাকার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। শব্দদূষণে বাংলাদেশেরই আরেক শহর রাজশাহী রয়েছে চতুর্থ স্থানে। এর আগে একাধিকবার বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শহরের তালিকায় ১ নম্বরে নাম ওঠে রাজধানী ঢাকার। প্রতিবেদনে শব্দদূষণ কীভাবে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তৈরি করছে, সে বিষয়েও তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, মানুষের জন্য ঘরের ভেতর শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর ঘরের বাইরে বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল। শব্দদূষণের প্রধান উৎস হচ্ছে সড়কে চলাচলকারী যানবাহন। এ ছাড়া উড়োজাহাজ, ট্রেন, শিল্পকারখানা ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডেও শব্দদূষণ তৈরি হয়। মানমাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

মানুষের কান যেকোনো শব্দের ব্যাপারে যথেষ্ট সংবেদী। তীব্র শব্দ কানের পর্দাতে বেশ জোরে ধাক্কা দেয়। যা কানের পর্দাকেও নষ্ট করে দিতে পারে এই শব্দত্রাস। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের ধারণামতে, শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবেল বা তার বেশি হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। উচ্চশব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে একজন মানুষের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চশব্দ মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শব্দদূষণে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগ ও উদ্বেগজনিত সমস্যাসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

পরিবেশবিদ ও হর্ন বাজানো সচেতনতা নিয়ে কাজ করা শাখাওয়াত উল্লাহ জানান, যানবাহনের চালকদের অযথা হর্ন বাজানোর কারণে ঢাকার শব্দদূষণ-পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। নিষিদ্ধঘোষিত হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না। ঢাকার বাসিন্দাদের শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার বড় কারণ হর্নের আওয়াজ। হর্ন বাজানো বন্ধে আইন ও বিধিমালা থাকলেও, সেগুলোর প্রয়োগ সীমিত। হর্নের অযথা ব্যবহার বন্ধে আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ পুলিশের ধানমন্ডি থানার উপপরিদর্শক মো. ফরহাদ হোসেন জানান, ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ৮৮ ধারা অনুযায়ী, উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজালে অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবে কর্তৃপক্ষ।

মিরপুরের বাসিন্দা আইনজীবী মারুফ হোসেন নিয়মিত ভাড়া-বাইকে যাতায়াত করেন। তিনিও অতিরিক্ত হর্নে কারণে অতিষ্ঠ। তার মতে, ‘শব্দদূষণ বিধিমালার প্রয়োগে ব্যর্থতা রয়েছে। মোটরসাইকেলের ব্যবহার বেড়েছে, যা হর্নের বড় উৎস। হর্নের ব্যবহার বন্ধে সচেতনতার পাশাপাশি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে কঠোর হতে হবে।’

মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ ঢাকার বাসিন্দাদের মানসিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে জানান মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সংগঠন মনের বন্ধুর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদা শিরোপা। তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত হর্নের কারণে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পরে। এর ফলে শহরের মানুষ দিন দিন মানসিকভাবে অসুস্থ হচ্ছে যাচ্ছে এবং সেটা দ্রুতগতিতেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া যানবাহনের অতিরিক্ত হর্ন শিশুদের শেখার আগ্রহ কমিয়ে দেয়। তাই শিশুরা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়। উচ্চ শব্দদূষণের কারণে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। বাড়িতে ও অফিসে সারাক্ষণ মেজাজ খিটখিটে থাকে।’

সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফোরিক পলিউশন স্টাডিজের (ক্যাপস) এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় এলাকাভেদে আগের বছরের চেয়ে প্রতিবছর ৭ থেকে ১০ শতাংশ করে শব্দদূষণ বাড়ছে এবং মাত্রা দিন দিন গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই মাত্রা যদি কমানো না যায়, তাহলে ঢাকা শহর বসবাসের অনুপযোগী নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।