হলদে বউয়ের করুণ কান্না

হলদে বউ পাখি। কুষ্টিয়া শহর থেকে তোলা
ছবি: এস আই সোহেল

গত ৩ মার্চ, আমি তখন গ্রামের বাড়িতে। বাড়ি লাগোয়া ছোট পুকুরটার চারপাশজুড়ে আম, কাঁঠাল, বেল, নারকেল, সুপারির গাছ। একটি মাত্র সোনালুগাছ তামাটে-সবুজ পাতায় নিজেকে সাজিয়েছে ভরা বসন্তকালে।

কদিন বাদেই ওই গাছটাতে ফুটবে ফুল—সোনালি হলুদ ফুলের ওই গুচ্ছগুলো ঝাড়বাতির মতো ঝুলবে-দুলবে গাছটিতে। ওই ঝাড়বাতিগুলোতে যখন খাবারের সন্ধানে দুলবে-ঝুলবে ও লম্ফঝম্ফ করবে টকটকে হলুদ রঙের হলদে বউ পাখি—থাকতে পারে এগুলোর সঙ্গে সদ্য উড়তে শেখা ছানারা। তখন অপার্থিব দৃশ্যের অবতারণা হবে।

তখনো ঝিঁঝিরা ‘কনসার্ট’ শুরু করেনি, ফোটেনি ফুল সোনালু গাছটিতে। তবে পুকুরপাড়ের একটি আমগাছ তার একখানা ডাল হাতের মতো বাড়িয়ে দিয়েছে পুকুরটার দিকে—পানি থেকে ফুট পনেরো ওপরে, ওই ডালখানার আগার দিকের তিনখানা সরু প্রশাখার ভেতরে হলদে বউয়ের বাসা, সে বাসায় বসে ডিমে তা দিচ্ছে মেয়ে ও পুরুষটি পালা করে।

আমি গ্রামের বাড়ি, বাগেরহাটের ফকিরহাটে গিয়েছিলাম গত ২৫ ফেব্রুয়ারি, যাওয়ার পর থেকেই শুনছি পুরুষ পাখিটির কাটুম-কুটুম, কুটরুম উম, উয়ে ইউ-ইউ ধরনের মহানন্দের ডাক ও গান—দেখছি মহা খুশির ওড়াউড়ি। মেয়েটিই ডিমে তা দিচ্ছে বেশি। পুরুষটি উড়ে-ঘুরে আর হাঁকডাক করে বাসার ত্রিসীমানা পাহারা দিচ্ছে। ডাকাত পাখি কানাকুকো ও হাইজ্যাকার পাখি হাঁড়িচাঁচা এসে খেয়ে যেতে পারে ডিম—কোকিল, বউ কথা কও, চোখ গেল ও পাপিয়া পাখিরা সুযোগ পেলেই চুরি করে ডিম পেড়ে যাবে। দুটিতেই সুযোগমতো তড়িঘড়ি খাবার খেয়ে নেয়।

মূল খাবার এদের শুঁয়াপোকা ও এ–জাতীয় রসাল পোকা, অন্যান্য পোকামাকড়, ফল, ফুলের মধুরেণু। সুযোগ থাকলে তাল-খেজুরের রস পান করে ও আখখেতের মাজরা পোকা খায়। এই পাখিদের প্রেম খুব গাঢ়-গভীর, কোনো কারণে একটির মৃত্যু হলে অন্যটি তিন–চার দিন ধরে করুণ সুরে কেঁদে কেঁদে উড়ে ঘুরে ও গাছপালায় উঁকিঝুঁকি মেরে সঙ্গীকে খোঁজে।

আমার বাড়ি লাগোয়া ওই পুকুরের মালিক চাইলেন কিছু ছোট, মাঝারি গাছসহ বড় গাছের ডালপালা কেটে লাকড়ি বানাবেন। খবরটা জেনে আমি ওই গাছের মালিক ও গাছকাটা শ্রমিকদের সাবধান করলাম—বাসাওয়ালা ডালখানা যেন কাটা না হয়।

তবু ভুলে এক সকালে ওই ডালখানাই কাটা পড়ল—পুকুরে পড়ল সশব্দে, আমি এসে পুকুরে নেমে ডালখানা টেনে ডাঙায় আনলাম—হলদে বউ দম্পতি উড়ে উড়ে আমার মাথার ওপর ঘুরে ঘুরে করুণ সুরে কাঁদছে—আহাজারি করে মিনতির সুরে যেন বাসা-ডিম-ছানা ফেরত চাইছে আমার কাছে! বিলাপ ও কান্না-মিনতির সে সুরের বর্ণনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই।

মনে দুঃখ বাজল খুব। বাসাটি আলতো টানে উঠিয়ে ফেললাম। হয়তোবা ফুটেছিল দু-একটি ছানা! সব এখন জলের তলায়।

ঢাকা শহরসহ সারা দেশে দেখতে পাওয়া গ্রামবাংলার প্রায় সবার চেনাজানা হলদে বউয়ের ইংরেজি নাম ব্ল্যাক–হুডেড ওরিওল। বৈজ্ঞানিক নাম Oriolus xanthornus. দৈর্ঘ্য ২৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৮০ গ্রাম।

একনজরে টকটকে হলুদ রঙের পাখি, মাথা-ঘাড় কালো, গোলাপি ঠোঁট ও কালো রঙের পা। বাসা বাঁধার ভরা মৌসুম বসন্ত—শরৎকাল।

শরীফ খান, পাখি বন্য প্রাণিবিষয়ক লেখক