হারগোজা

হারগোজা ফুল, সুন্দরবন থেকে তোলা l ছবি: লেখক
হারগোজা ফুল, সুন্দরবন থেকে তোলা l ছবি: লেখক

রাতের আঁধার কেটে যখন আলো জেগে উঠল, তখন আমরা পৌঁছে গেছি সুন্দরবনের নির্জন গহিনে। পাখিরা এ-গাছ থেকে ও-গাছে উড়ে যাচ্ছে। মাছরাঙা পাখি কেওড়ার ডালে বসে আছে চুপ মেরে, মাছ শিকারের আশায়। হরিণের পাল ভিড় জমিয়েছে নদীতীরের ঘাসবনে, ভাটার অপেক্ষায়। জল কমলেই কেওড়ার বনে যাবে কচিপাতার স্বাদ নিতে। বেঙ্গল ট্যুরসের বোটের ছাদে বসে বসে সুন্দরবনের প্রকৃতি দেখা যায়। সুন্দরবনের অনেক গাছপালার মধ্যে অন্যতম হারগোজা। সুন্দর ফুলের জন্যই তার কদর আমাদের কাছে বেড়ে গেছে। গুল্মজাতীয় এ গাছটি সুন্দরবনের সর্বত্রই দেখা যায়। হারগোজা যেখানে জন্মে সেখানে নোনা জলের জোয়ার-ভাটা থাকতে হবে। তাই এটি লবণাক্ত পরিবেশ চেনার একটি নির্দেশক উদ্ভিদ।
যেখানে লবণাক্ত পানি ও মাটি খুঁজে পাওয়া যাবে সেখানের কোনো নদী বা খাল কিংবা নালার পাশে দেখা পাওয়া যাবে হারগোজা গাছের। নোনা জলের ধারে খুব ঘন হয়ে কাঁটাময় এ গুল্ম বেড়ে ওঠে। দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা জেলার নোনাজলমিশ্রিত জলাশয়ের কিনারে অযত্নে বেড়া ওঠা কণ্টকিত কাণ্ডের শীর্ষে নীলের আভা নিয়ে ফোটে হারগোজা ফুল। চকরিয়া, মহেশখালী, টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও এগুলো আছে। কারণ, উপকূল ধরে বীজ ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়েছে।
গুল্মজাতীয় এ গাছের কাণ্ডের উচ্চতা চার-পাঁচ ফুট, পাতার কিনারা ঢেউখেলানো ও কাঁটাময়। পাতা ১৫ সেন্টিমিটার, ফুল নীল। এই কাঁটার জন্য এ গাছের শত্রু কম। মানুষ ধারে-কাছে আসে না। তবে মৌমাছি সারাক্ষণই ভিড় জমায় মধুর জন্য।
ফুল আসে গ্রীষ্মকালে। হারগোজার বৈজ্ঞানিক নাম Acanthus ilicifolius, গোত্র Acanthaceae। হারগোজার পাতার রস বাতযন্ত্রণা লাঘব করে। শিকড় সাপের বিষক্রিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। ইংরেজিতে এ গাছকে বলা বলা হয় Holly Mangrove। হারগোজা যেখানে জন্মে সেখানে ভূমিক্ষয় রোধ হয়। ঢেউয়ের প্রকোপ শিকড় ও ঘনভাবে জন্মানো কাণ্ড প্রতিরোধ করে নদী বা খালের পাড় সংরক্ষণ করে। সুন্দরবনের মধুপায়ী পাখিরা, বিশেষ করে মৌটুসিরা মধু খেতে এ-গাছের ফুলে ফুলে বিচরণ করে। কয়েক প্রজাতির জলচর পাখি যেমন মেটেপা ঝিল্লি, মেটেবুক ঝিল্লি, ধলাবুক ডাহুক, লালবুক গুরগুরি হারগোজার ঝোপে বাসা করে। কাঁটাময় এ গাছের ঝোপ পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়।