শ্যালা গাঙ থেকে ভেরির খালের দিকে কয়েক শ মিটার পশ্চিমে আমাদের বোট নোঙর করা। সকাল থেকে হরিণটানা বনে বাঘের শিকার প্রাণীর সার্ভে কাজ করতে করতে বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাই তাম্বুলবুনিয়া টহলফাঁড়ি। এলাকাটি পূর্ব সুন্দরবনের দিকে। নিরাপদে রাত কাটাতে হাউসবোট সাধারণত সুন্দরবনের সরু কোনো খালে রাখা হয়। আমাদের বোটের চালক ছগির মিয়াও তাই করল। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি, সুন্দরবনে শীতের আমেজ আসি আসি করছে।
এ সময় সূর্য বনের গভীরে তলিয়ে যাওয়ার বেশ খানেক আগেই বনতলে অন্ধকার নেমে আসে। তাই আগেভাগেই সার্ভে বোট থেকে আমাদের হাউসবোটে উঠে এসেছি। শ্যালা গাঙ আর ভেরির খালের মোহনায় তখনো শেষ সূর্যের আলো চিকচিক করছে। পানিতে ভাটার টান, ফলে সেখানে জড়ো হয়েছে নদীর শুশুকের দল। মাছের পেছনে ছুটছে। দূর থেকে ক্যামেরায় শুশুকের ছবি তুলতে বোটের ডেকে বসে আছি। শুশুকের ছবি তোলা ভারি দুষ্কর। তারপরও এমন বিরল প্রাণীর একটি ভালো ছবি তুলতে পারলে মনটা আনন্দে ভরে যায়।
দূরের কেওড়াবনের মাথার ওপর দিয়ে টকটকে লাল সূর্যটা একসময় ডুবে গেল। কিছুটা আবছা দেখাচ্ছে বনটা। বনের পাখিরা দল বেঁধে নীড়ে ফিরছে। ইতিমধ্যে বোটে রাতের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ ছগির মিয়া দৌড়ে এসে বলল, ‘স্যার, স্যার, তাড়াতাড়ি ক্যামেরা নিয়া আসেন।’ আমিও পড়িমরি করে দৌড় দিলাম ছগিরের পিছু পিছু। গিয়ে ঢুকলাম তারই রুমে, যেখান থেকে সে বোট পরিচালনা করে। রুমের ভেতরের সামনের স্বচ্ছ জানালার গায়ে বসে আছে এক অতিকায় মথ। আমাদের অবাক করে দিয়ে পাশের বন থেকে মুহূর্তেই আরও একটি মথ ঢুকে পড়ল রুমে। অন্যান্য পতঙ্গের মতো এই মথও আলো দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে রুমে ঢুকে পড়েছে। মথটি প্রথমবার দেখেছিলাম ২০০১ সালে পশুর নদের এক ভারানিতে। তবে ছবি তোলার আগেই পালিয়েছিল সেবার।
বৃহদাকার এই মথের নাম অ্যাটলাস। প্রাচীন গ্রিসের অধিবাসীদের বিশ্বাস, অ্যাটলাস নামের এক মহাবীর পৃথিবীকে নিজ কাঁধের ওপর ধরে রেখেছেন। মথটির দুই পাখার মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় ১২ ইঞ্চি। আকারে এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম মথ। তাই গ্রিকদের মহাবীরের নামের সঙ্গে মিল রেখে এ মথের নাম রাখা হয় অ্যাটলাস। স্ত্রী মথ পুরুষের চেয়ে বড় হয়।
মজার ব্যাপার হলো, এত বড় পাখনার মথের দেহ বেশ ছোট। পাখনার ওপরের নানা রঙের আঁকিবুঁকি ও রেখা থাকে, নিচের দিকটা লালচে বাদামি। সামনের পাখনার শেষ প্রান্তে গোলাপি রঙের মধ্যে কালো চোখের মতো ফোঁটা দেখে মনে হবে সাপের মাথা। কোনো শিকারি যেন একে আক্রমণ করতে সাহস না করে, সে কারণে এমন পাখনা। কেউ আক্রমণ করতে এলে পাখনা এমনভাবে নড়াচড়া করে, যেন এক্ষুনি ছোবল দেবে। আসলে এটি একটি উপকারী পতঙ্গ।
অ্যাটলাস মথ বেশ বিরল প্রজাতির পতঙ্গ। এদের খাদ্য গ্রহণের শোষক অঙ্গ সুগঠিত নয়। এরা যখন গুটি পাকিয়ে জীবন কাটায়, তখন শরীরে চর্বি জমিয়ে রাখে। সেই জমানো চর্বি থেকে পূর্ণাঙ্গ বয়সে শক্তি ব্যবহার করে বেঁচে থাকে। ফলে এদের আয়ু হয় মাত্র চার-পাঁচ দিন। সুন্দরবনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের এটি একটি স্মারক।
এম এ আজিজ, সুন্দরবন ও বাঘ–গবেষক