তুরমতি বাজ দেখতে হাসনাবাদে

কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে বিশ ২০ বেশি সময় ধরে একটি তুরমতি বাজ পরিবার বসবাস করছে। এ বছরের ১৮ এপ্রিল এই পরিবারের একটি বাচ্চার ছবি তুলেছেন নিয়াজ আব্দুর রহমান।

সাতসকালে পৌঁছালাম ঢাকার কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে। সময়টা এ বছরের এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখ। সঙ্গে আছেন বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ ফিল্মমেকার নাইজেল মারভেন। তুরমতি বাজ নামের একটি পাখি তাঁর তখনো অদেখা। বাংলাদেশে এসেছেন এ পাখিটি দেখতে। অনেক আগে থেকেই আমরা পরিকল্পনা করি, কীভাবে একটি পুরো দিন পাখিটির সঙ্গে কাটাব। তুরমতি বাজ দেখতে হলে এই পাখি নিয়ে কাজ করা একজনকে লাগবে। এ দেশে এই পাখি নিয়ে গবেষণা করেন এ রকম মানুষ একজনই আছেন। নাম তাঁর মোহাম্মদ ফয়সাল। প্রায় দুই যুগ ধরে এই পাখির পেছনে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করছেন।

ফয়সালের সঙ্গে আমার মাঠে–ময়দানে পাখি দেখার সময়ও প্রায় দুই যুগ। তাঁর বেশির ভাগ সময়ই কাটে এ পাখিটি নিয়ে গবেষণায়। তুরমতি বাজ দেখতে যাব শুনে ফয়সাল খুব খুশি হলেন। পুরো দিন পাখি দেখার পরিকল্পনা হলো।

হাসনাবাদের একটি বিদ্যুতের টাওয়ারে এই পাখিটির বাসা আছে। ফয়সাল বললেন, এখানে গেলে সবচেয়ে ভালো করে পাখিটি দেখা যাবে। টাওয়ারের কাছে পৌঁছাবার এক মিনিটের মধ্যে পাখিটির দেখা পেলাম। দূর থেকে খালি চোখে পাখিটিকে দেখা বেশ মুশকিল। টেলিস্কোপ নিয়ে তার বাসা আর বাচ্চার দেখা পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম মা পাখিটি শিকার করে খাবার নিয়ে হাজির। বাচ্চারা খাবার পেয়ে খুব খুশি। বাসার কাছাকাছি তিনটি বাচ্চার দেখা পেলাম। ঘণ্টাখানেক ওই এলাকায় কাটালাম।

ঢাকার ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তুরমতি বাজের এ ছবি গত বছর তুলেছেন ব্রিটিশ পাখিবিজ্ঞানী গ্যারি অলপর্ট।

তুরমতি বাজ একটি মাঝারি আকারের শিকারি পাখি। ইংরেজিতে বলে রেড-নেকড ফ্যালকন। বাংলায় এই পাখিটির পুস্তকি নাম লালঘাড় শাহিন। পৃথিবীব্যাপী এ পাখিটি প্রায় সংকটাপন্ন পাখি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। হাসনাবাদের এই এক জোড়া বাজ ২০০৬ সাল থেকে ওই এলাকায় বাস করছে। বলা যায়, এই জোড়ার আদি নিবাস! ফয়সাল তখন থেকেই এই বাসা ও পাখি জোড়ার তথ্য সংগ্রহ করছেন। এখন পর্যন্ত পাখিটি নিয়ে দারুণ সব তথ্য পেয়েছেন, যার মধ্যে কিছু তথ্য গোটা পৃথিবীতেই নতুন। প্রায় বিশ বছরে এই এক জোড়া বাজপাখি প্রায় অর্ধশতরও বেশি বাচ্চা দিয়েছে। ২০১৪ সালে এক মর্মান্তিক ঘটনায় এই জোড়ার পুরুষ পাখিটি মারা যায়। পাখিটি পায়ে আঘাত পেয়েছিল। প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে পাখিটি মারা যায়। এই সময়ের মধ্যে অন্য একটি পুরুষ বাজ মেয়েটির সঙ্গে জোড় বাঁধে। সেই সময় তাদের ঘরে ছিল তিনটি বাচ্চা। নতুন পিতা বাচ্চাগুলোর খাবার ও দেখাশোনার দায়িত্ব নেয়।

বাংলাদেশে ফ্যালকন পরিবারের ১০টি প্রজাতি আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম প্রাণীর একটি প্রজাতি হলো এই বাজ পাখি। তুরমতি বাজকে পাহাড়ি এলাকা বাদে প্রায় সব এলাকায় দেখা যায়। শহুরে পাখি নামেও এই পাখির খ্যাতি আছে। নগরে মোবাইল টাওয়ার বা বিদ্যুতের টাওয়ার বেড়ে যাওয়ার তাদের বাসা বানাতে সুবিধা হয়েছে।

তুরমতি বাজের খাবার তালিকার প্রায় ৭৫ শতাংশই হলো পাখি। এর মধ্যে চড়ুই পাখিই সবচেয়ে বেশি শিকার করে খায়। অনেক সময় চামচিকাও ধরে। শিকারি পাখি হওয়ায় এরা নিজেদের টেরিটরি দখল করে রাখে। এক জোড়া পাখি যখন জোড় বাঁধে তখন তার সীমানায় অন্য কাউকে ঢুকতে দেয় না। জোর করে ঢুকতে চাইলে মারামারি হয়।

হাসনাবাদের তুরমতি বাজের এই বিশ বছরের সংসার নিজ চোখে দেখা সত্যিই আনন্দের। পাখিটির বাসার আশপাশে একসময় তেমন বসতি ছিল না। এখন দালান আর মানুষে ভরা। এক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের দেখতে অনেক মানুষের ভিড় শুরু হলো। ফয়সালকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর প্রিয় খাবারের দোকানে নাশতা করলাম। তারপর অন্য আরেকটি বাসা দেখতে গেলাম কেরানীগঞ্জের আরাকুলে। নাইজেল মারভেনের সঙ্গে এই পাখিটি দেখার মধুর স্মৃতি কখনো ভুলব না।

  • সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণী গবেষক