দুপুরের খাবার শেষ করেই নিঝুম দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবগাহনের জন্য দলে–বলে বেরিয়ে পড়লাম। শীত শীত দুপুরে সূর্যের আলোর তাপ গায়ে লাগায় বেশ আরামই লাগছিল। গ্রামের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে খালের পাড়ে এসে নৌকায় চড়লাম।
নিঝুম দ্বীপের বিপরীত পাড়ের কবিরাজের চরে যেতেই বিকেল হয়ে গেল। চরে বেশ পাখি থাকলেও নরম কাদার জন্য নামতে পারলাম না। কী আর করা! দূর থেকে পাখি দেখেই বিদায় নিতে হলো। কারণ, ৩০০ মিলি প্রাইম লেন্স সঙ্গে আনা হয়নি।
কবিরাজের চর থেকে চৌধুরী খালের দিকে রওনা হলাম। আলো থাকতে থাকতে খালের পাশের চরে যেতে হবে। ওখানে খানিকক্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করব, সূর্যাস্ত দেখব ও সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে চরের পাশের বনে চিত্রা হরিণের সন্ধান করব।
যাহোক, কবিরাজের চর থেকে এসে চৌধুরী খালে ঢোকার মুখেই চরে শখানেক সোনারঙা ছোট ছোট সৈকত পাখির দেখা মিলল। পাখিগুলোকে আগেও দেখেছি চট্টগ্রামের পতেঙ্গায়, কক্সবাজারের সোনাদিয়ায়, সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে এবং বরিশাল শহরের পাশের রুইয়া গ্রামে।
কিন্তু নিঝুম দ্বীপের মতো এত পাখি একসঙ্গে কখনোই দেখিনি। পাখিগুলো ছোট লেন্সের রেঞ্জের মধ্যে থাকায় সহজেই ক্লিক করতে পারলাম। সম্প্রতি এদের আবারও দেখলাম মুন্সিগঞ্জের কালীর চরের কাছে।
আদুরে এই পাখিগুলোর দেহের ওপরটা ধূসর-বাদামি; তার ওপর হলদে থেকে সোনালি ছোট ছোট দাগ থাকে। দেহের নিচটা কালচে-বাদামি ও তাতে বাদামি, ধূসর ও হলদের মিশেল। ভ্রু-রেখা, গাল ও ঘাড়ে পীতাভ আভা।
ডানার সরু সাদা ডোরা ও বাদামি-ধূসর পালকতল-ঢাকনি ওড়ার সময় স্পষ্ট নজরে পড়ে। কিন্তু প্রজননকালে ওদের ধূসর-বাদামি পিঠে কালো ও সোনালির মেলা বসে যেন! মুখমণ্ডল, ঘাড়ের নিচ, বুক ও পেট হয় কালো। সাদা ফিতার মতো একটি চওড়া দাগ কপাল থেকে চোখের ভ্রুরেখা পর্যন্ত নেমে যায়। চোখের রং সব সময়ই কালচে-বাদামি। চঞ্চু কালো।
পা, পায়ের পাতা ও আঙুল শ্লেটের মতো ধূসর। স্ত্রী-পুরুষে পার্থক্য নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পেট ফ্যাকাশে; তাতে থাকে আবছা কালচে ডোরা। লম্বায় ২৩ থেকে ২৬ সেন্টিমিটার, প্রসারিত ডানা ৬০ থেকে ৭২ সেন্টিমিটার এবং ওজন হয় ১০০ থেকে ২২৮ গ্রাম।
শীতে দেশের সব ধরনের জলাশয়, সেন্ট মার্টিন, হাতিয়াসহ উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চল, উন্মুক্ত প্রান্তর, ফসলের খেত ইত্যাদিতে ছোট বা বড় দলে দেখা যায়। স্যাঁতসেঁতে বেলাভূমিতে হেঁটে বা দৌড়ে খুদে শামুক, কাঁকড়া, কেঁচো, পোকামাকড়, চিংড়ি, উদ্ভিদের বীজ ইত্যাদি খুঁজে খায়। একসঙ্গে দল বেঁধে ওড়াউড়ি করে। ওড়ার সময় বাঁশির মতো ‘চি-ভিট—-’ বা ‘কিউ-ঈক—-’ শব্দে ডাকে।
জুন থেকে জুলাই প্রজননকাল। এ সময় উত্তর এশিয়া ও পশ্চিম আলাস্কার তুন্দ্রা অঞ্চলের উদ্ভিদ ঢাকা মাটিতে সামান্য গর্ত করে তাতে শৈবাল, ঘাস ও পাতা দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে চারটি। রং কালচে-বাদামি, ছিটছোপসহ হলদে থেকে দারুচিনি। পুরুষ দিনে ও স্ত্রী রাতে ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ২৫ থেকে ২৬ দিনে। স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে ছানাদের লালন–পালন করে। ছানারা ২৬ থেকে ২৮ দিন বয়সে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল ৫ থেকে ৬ বছর।
চমৎকার সোনারঙা এই পাখিগুলো এ দেশের বহুল দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখি কইতরি চ্যাগা। মুরগি বাটান, মেটে বাটান, সোনা বাটান বা মিটুয়া (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম প্যাসিফিক গোল্ডেন প্লোভার বা ইস্টার্ন গোল্ডেন প্লোভার। গোত্র চ্যারাড্রিইডি, বৈজ্ঞানিক নাম Pluvialis fulva। অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ভুটান বাদে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ