রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া পরিবেশের ক্ষতি কাটানো যাবে না

‘ঢাকার পরিবেশ: পানি, বায়ু এবং শব্দদূষণ বিষয়ে নীতি, আইনি কাঠামো ও জন-আকাঙ্ক্ষা’ শীর্ষক নাগরিক সংলাপ আয়োজন করে পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশছবি: দীপু মালাকার

দেশে পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। সরকার উদ্যোগ না নিলে এ সমস্যার কোনো কার্যকর সমাধান হবে না। তবে নাগরিকদের নিষ্ক্রিয় থাকা চলবে না। জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রাখতে হবে।

আজ বৃহস্পতিবার এক নাগরিক সংলাপে পরিবেশবিশেষজ্ঞ ও মাঠপর্যায়ের অংশীজনের বক্তব্যে এসব কথা উঠে আসে। দুপুরে সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ঢাকার পরিবেশ: পানি, বায়ু এবং শব্দদূষণ বিষয়ে নীতি, আইনি কাঠামো ও জন-আকাঙ্ক্ষা’ শীর্ষক এই নাগরিক সংলাপ আয়োজন করে পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ।

সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় প্রচুর আইন ও চমৎকার কৌশল, অভিযোজন পরিকল্পনা আছে কিন্তু সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না। পরিবেশ মন্ত্রণালয় আছে, সরকারের সদিচ্ছাও আছে, তারপরও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।’ তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, ঢাকা শহরের গড় তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। একইভাবে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে, শব্দদূষণ বেড়েছে। শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই পরিবেশের মানের উন্নতি হয়নি।

প্রধান অতিথি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলেন, অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানই নদী বা জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ করেছে। চলনবিল নিয়ে কাজ করার সময় সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছেন শুকিয়ে যাওয়া একটি নদীর ওপর মাটি ভরাট করে ভূমি অফিস করা হয়েছে। তবে সরকার প্রাকৃতিক সম্পদের অবনমন রোধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমানোর জন্য দীর্ঘ মেয়াদের ‘ডেলটা প্ল্যান’ তৈরি করেছে। এর আওতায় প্রধান নদ-নদীগুলো খনন করে নাব্যতা বজায় রাখা হচ্ছে। ফলে ১৯৮৮ সালের মতো ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যা এখন আর হচ্ছে না।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর অন্যতম। তাঁরা গবেষণায় পেয়েছেন ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা বর্ষা মৌসুমে সবচেয়ে কম থাকে, তবু তা সহনীয় মাত্রার দ্বিগুণ। শরৎকালে এই দূষণ পাঁচ গুণ এবং শীতকালে ১০ গুণ বৃদ্ধি পায়। সরকারিভাবে সচিবালয় এলাকাকে রাজধানীর সবচেয়ে নীরব এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এখানেই শব্দদূষণ সবচেয়ে বেশি। একইভাবে ঢাকার চারপাশে তুরাগ, বালু, বুড়িগঙ্গা নদীর পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, জলজ জীবের জন্য যেখানে প্রতি লিটারে ন্যূনতম ৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন, বর্ষা মৌসুমেও তা পাওয়া যায় না। আর শুকনো মৌসুমে অক্সিজেন থাকে দশমিক ৫ মিলিগ্রাম, কোথাও কোথাও আরও কম।

পরিবেশ রক্ষায় আইনের ভূমিকা নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল-র সহযোগী প্রভাষক গোলাম সারওয়ার বলেন, পরিবেশ নিয়ে দেশে দুই শতাধিক আইন ও নীতিমালা রয়েছে। তারপরও মারাত্মকভাবে নদী দখল, পানিদূষণ, শব্দদূষণ হচ্ছে। আইনের মধ্য থেকেই আইনগতভাবে দূষণ করা হচ্ছে। যেমন আইনে বলা আছে পাহাড় কাটা বা বনের গাছকাটা বা জলাভূমি ভরাট করা যাবে না। আবার সেখানেই বলা হয়েছে, তবে জাতীয় প্রয়োজনে করা যাবে। জাতীয় প্রয়োজন ঠিক কী, তার ব্যাখ্যা স্পষ্ট নয়। যেসব দেশে আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই, ইউএনডিপির এমন এক তালিকায় অন্যতম হিসেবে বাংলাদেশের নাম এসেছে।

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আজিজুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সামগ্রিকভাবে বছরে আমাদের প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু পরিবেশসংক্রান্ত আইনগুলো যদি যথাযথভাবে প্রয়োগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না পারি, তবে জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবিলায় গঠিত আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে আমরা প্রত্যাশিত ক্ষতিপূরণের অর্থ পাব না।’

নদী ও বদ্বীপ গবেষণাকেন্দ্রের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, উন্নয়নবিষয়ক যেকোনো পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবেশের গুরুত্বকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশে রক্ষার বিষয় নিয়ে বলেন পরিবেশকর্মী ফয়সাল আহমেদ।

নাগরিক সংলাপে অংশীজন হিসেবে তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গার তীরে বসবাসকারীদের নিয়ে গঠিত নদী মোর্চার প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বেসরকারি উপদেষ্টা এম এস জিয়াউল হক।

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের আহ্বায়ক শরীফ জামিলের সঞ্চালনায় এই নাগরিক সংলাপে পরিবেশ সুরক্ষায় পাঁচ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে নদী ও পরিবেশদূষণের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার জন্য পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করা, নদী ও পরিবেশদূষণ প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে টাস্কফোর্স গঠন, নদীরক্ষা কমিশনের ক্ষমতার পরিধি বৃদ্ধি করা, উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের আগে পরিবেশের গুরুত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং কারখানা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ।