অবশেষে বনে বিপন্ন বনছাগল
২৬ ডিসেম্বর ২০২৩। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শক্তিয়ারখলা বনবিটের ঢুলারা বিজিবি ক্যাম্প এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় বিজিবি সদস্যরা মায়া হরিণের মতো লালচে-বাদামি বর্ণের খানিকটা বড় আকারের একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী উদ্ধার করেন। এরপর তাঁরা প্রাণীটিকে সুনামগঞ্জ বন বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করেন। সুনামগঞ্জ বন বিভাগ এটিকে ট্রাকযোগে সিলেটের বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠায়।
সেখান থেকে ওই রাতেই মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া বন্য প্রাণী উদ্ধারকেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। পরের দিন দুপুরে প্রাণীটিকে শ্রীমঙ্গলের বন্য প্রাণী উদ্ধারকারী সংগঠন ‘স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেনজারড ওয়াইল্ডলাইফ (সিউ)’-এর সদস্যদের সহযোগিতায় মৌলভীবাজার বন বিভাগ কমলগঞ্জের রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে ছাড়ার জন্য নিয়ে যান। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত এটিকে ওখানে না ছেড়ে জানকিছড়ায় ফেরত আনা হয়।
সংশ্লিষ্ট অনেকেই ধারণা করেন, কোনো অদৃশ্য হাতের ইশারায় বিরল প্রাণীটিকে সাফারি পার্কে পাঠানোর চেষ্টা চলছিল। কিন্তু সিউর সদস্য ও মৌলভীবাজারের বন বিভাগের কর্মকর্তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সন্ধ্যার দিকে এটিকে আবার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। আশা করা যায়, প্রাণীটি ওখানে টিকে থাকবে। কারণ, ২০২২ সালে রাজকান্দি সংরক্ষিত বনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক স্নেহাস্পদ মুনতাসির আকাশের এক গবেষণায় ব্যবহৃত ক্যামেরা ট্র্যাপে বাচ্চাসহ প্রাণীটির অস্তিত্ব ধরা পড়ে।
একদা চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ি মিশ্র চিরসবুজ বনে অবাধে বিচরণ করত প্রাণীটি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান শিকার ও বনভূমি উজাড় এদেরকে করল বিপন্ন; মারাত্মকভাবে হ্রাস পেল সংখ্যা। গত তিন-চার দশকে এদের আবাস এলাকার প্রায় অর্ধেকই উজাড় হয়ে গেছে। মৌলভীবাজারের একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা থেকে ২০১১ সালে এই প্রজাতির দুটি প্রাণী উদ্ধার করে কক্সবাজারের ডুলাহাজারার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে রাখা হয়েছিল। খবর পেয়ে ওই বছরের ১৫ জুলাই ওখানে গেলাম, প্রাণী দুটিকে পর্যবেক্ষণ করে ওদের বুনো স্বভাবের সঙ্গে পরিচিত হলাম এবং ছবি তুললাম। কিন্তু কিছুকাল পর প্রাণীগুলো মারা যায়। সে সময় প্রাণীগুলোকে সাফারি পার্কে না রেখে বান্দরবান, রাঙামাটি বা চট্টগ্রামের উপযুক্ত পরিবেশ ছেড়ে দিলে হয়তো বেঁচে যেত।
যাহোক, বান্দরবানের প্রত্যন্ত সাঙ্গু-মাতামুহুরী উপত্যকার স্থানীয় ম্রোদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং সেখানকার বন্য প্রাণী ও তাদের আবাস সংরক্ষণে নিয়োজিত ‘ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স’ (সিসিএ)। ২০১৭ সালে তারা ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে প্রথম বান্দরবানে প্রাণীটির অস্তিত্বের প্রমাণ পায়। পরে ২০২০ সালে আলিকদমের কুরুকপাতা ইউনিয়নের মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনের দুর্গম ইয়ংনং পাড়ায় গিয়ে সিসিএর প্যারাবায়োলজিস্টরা মুরং ভাষায় ‘নিয়া’ নামে লালচে-বাদামি বিরল তৃণভোজী বাচ্চা প্রাণীকে বাঁধা অবস্থায় দেখেন। পরে তাঁরা বন বিভাগের সহায়তায় বাচ্চাটি উদ্ধার করে উপযুক্ত আবাসস্থলে ছেড়ে দেন।
এতক্ষণ লালচে-বাদামি যে বন্য প্রাণীটির খণ্ড খণ্ড গল্প বললাম, সে হলো এ দেশের একটি বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী বনছাগল বা পাহাড়ি ছাগল। ইংরেজি নাম সেরাও, রেড বা মেইনল্যান্ড সেরাও। বোভিডি অর্থাৎ গরু গোত্রের প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Capricornis rubidus। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বনছাগলের দেখা মেলে।
বনছাগলের দৈর্ঘ্য ১.০ থেকে ১.১ মিটার। ওজনে পুরুষ ৭০ থেকে ৭৫ কেজি এবং স্ত্রী ৫০ থেকে ৫৫ কেজি। দেহের লালচে-বাদামি পশমগুলো রুক্ষ ও লম্বা। রোমশ লেজটি ছোট। চোখের চারদিক ও খুরের ওপরের পশম সাদাটে। শক্তপোক্ত পা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে অনেকটা একই রকম।
এরা ঘন ঘাস-লতাপাতাপূর্ণ খাড়া পাথুরে পাহাড়ের ঢালে লোকচক্ষুর অন্তরালে একাকী বা ছোট দলে ঘুরে বেড়ায়। এদের চলাচলের পথ এতটাই সরু যে সরীসৃপ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর পক্ষে চলাচল করা কষ্টকর। তৃণভোজী ও জাবর কাটা প্রাণীটি সন্ধ্যা ও ভোররাতে ঘাস, বাঁশের কচি পাতা ও পাথরের গায়ে জন্মানো শেওলা খায়। দিনে পাহাড়ের চূড়ার বড় পাথরের আড়ালে বা গুহায় বিশ্রাম নেয় ও জাবর কাটে। অক্টোবর থেকে নভেম্বর প্রজননকাল। বনছাগী ৮ থেকে ৯ মাস গর্ভধারণের পর পাহাড়ের গুহা বা পাথরের ফাঁকে একটি বাচ্চা প্রসব করে। বিরল ও বিপন্ন প্রাণীটি সংরক্ষণে এখনই সঠিক পদক্ষেপ না নিলে অচিরেই বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।