বেগুনি ও নীল রঙের দুই ফুল 

বান্দরবানের নীলগিরির পথে ফুটেছে কেসুর ফুল
ছবি: লেখক

বান্দরবানের নীলগিরি থেকে রিসোর্টে ফিরছিলাম। মাঝেমধে৵ গাড়ি থামিয়ে ফুল দেখি, গাছ দেখি, ছবি তুলি। যেতে যেতে হঠাৎ একগুচ্ছ বেগুনি ফুল দেখে গাড়ি থামাই। লতানো গাছের ফুল। খানিকটা জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে আছে। সহযাত্রী সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমাকে ফুলটির নাম জিজ্ঞাসা করি। তিনি জানান, স্থানীয়ভাবে ঠান্ডা আলু নামে পরিচিত। এই নাম থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হলো, এটি একধরনের আলুগাছ। অর্থাৎ কন্দ থেকে একধরনের আলু পাওয়া যায়। এই আলু পাহাড়ের বাজারগুলোতে বিক্রি হতে দেখা যায়। সবজি হিসেবে এই আলু বাজারে অনেকবার দেখলেও ফুলটি যে এই আলুগাছের, তা ততক্ষণে স্পষ্ট হলো। গাছটির প্রচলিত অন্যান্য নামÑ—কেসুর, শাক–আলু, কেসুর-আলু ইত্যাদি থেকে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গাছটির ইংরেজি নাম ‘ইয়াম বিন’। ফল দেখতে শিমের মতো বলেই হয়তো এমন নামকরণ।

কেসুর-আলু (Pachyrhizus erosus) প্যাঁচানো লতার বড় ধরনের কন্দযুক্ত উদ্ভিদ। মূল সরল বা খণ্ডিত, শালগম আকৃতির, হালকা বাদামি চামড়া ও সাদা মাংসযুক্ত। কাণ্ড তামাটে রোমযুক্ত। পাতা ত্রিকোণ আকৃতির ও একান্তর। পত্রক ডিম্বাকার, মোটাভাবে দন্তর বা পাঁচ খণ্ডিত, উপপত্র ৫ থেকে ১০ মিলিমিটার লম্বা। ফুল অক্ষীয় রেসিমে বিন্যস্ত। মঞ্জরিদণ্ডের প্রতিটি পর্বে ঘন গুচ্ছে এক থেকে পাঁচটি ফুল ফোটে। বৃতি চার খণ্ডিত, অসমান। দলমণ্ডল বেগুনি বা সাদা। পুংকেশর ও পরাগধানী দ্বিগুচ্ছীয়। গর্ভাশয় প্রায় অবৃন্তক, গর্ভমুণ্ড উপগোলাকার। ফল শিমের মতো, চ্যাপ্টা, ৪ থেকে ১২টি বীজবিশিষ্ট। বীজ প্রায় বর্গাকার, চ্যাপ্টা, হলুদ, বাদামি বা লাল। ফুল ও ফলের মৌসুম অক্টোবর থেকে জানুয়ারি।

এ গাছের কন্দ বা আলু অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঁচা অবস্থায় সালাদের সঙ্গে ব্যবহার করা হয় অথবা সামান্য ভেজে ব্যবহার করা হয়। কন্দ কাঁচা অবস্থায়ও খাওয়া যায়। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কাঁচা ফল সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বীজের গুঁড়া কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানে ফুটেছে ব্লু সেইজ
ছবি: লেখক

এবার বলা যাক নীলচে রঙের ফুলটির কথা। দেশে আঞ্চলিক উদ্ভিদ উদ্যানগুলোর মধ্যে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানটি বেশ সমৃদ্ধ। প্রায় দুই দশক ধরে এই উদ্যানে যাতায়াত। সেখানে যতবারই গিয়েছি, পেয়েছি নতুন কিছু উদ্ভিদ। এই ফুলও এই উদ্যানে হঠাৎ পাওয়া। প্রচলিত কোনো নাম নেই। ইংরেজি নাম ‘ব্লু সেইজ’। কেউ কেউ অবশ্য নীলবাসক নামে চেনেন। তবে এই নামের নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র খুঁজে পেলাম না। অনেক উদ্ভিদের ভিড়ে ফুলটির চটকদারি রং মুগ্ধতা ছড়িয়ে রেখেছিল। এই লোভনীয় রঙে মজে গিয়ে অনেকগুলো ছবি তুলি। গুচ্ছবদ্ধ এই ফুলের বেশির ভাগই শুকিয়ে গিয়েছিল। কয়েক দিন আগে নিশ্চয় গাছজুড়ে ফুলের প্রাচুর্য ছিল। 

গাছটি (Eranthemum pulchellum) অনেক শাখাবিশিষ্ট, ছড়ানো এবং গুল্মশ্রেণির। এক থেকে দেড় মিটার উঁচু হতে পারে। পাতা দেড় থেকে আড়াই সেন্টিমিটার লম্বা, পত্রফলক ডিম্বাকৃতি-উপবৃত্তাকার, মূলীয়ভাবে ক্রমান্বয়ে সরু, স্পষ্টভাবে শিরাযুক্ত, শিরা ১০ জোড়া। ফুল আড়াই থেকে তিন সেন্টিমিটার লম্বা, নীল রঙের। ফুল মঞ্জরিপত্রবিশিষ্ট স্পাইক ও নিবিড়কাক্ষিক। মঞ্জরিপত্র দেখতে পাতার মতোই। বৃতি ৬ থেকে ১০ মিলিমিটার লম্বা, পাঁচ খণ্ডিত, খণ্ড প্রায় সমান, সাদাটে ও সূক্ষ্মভাবে রোমশ। দলমণ্ডল দুই থেকে তিন সেন্টিমিটার লম্বা, শীর্ষের কাছে প্রসারিত, পুংকেশর দুটি, পুংদণ্ড আড়াই সেন্টিমিটার লম্বা, পরাগধানী দুই থেকে তিন মিলিমিটার লম্বা ও সরুভাবে দীর্ঘায়ত। 

ফুল ও ফলের মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল। ফুলের সৌন্দর্যের জন্য আমাদের দেশে আলংকরিক উদ্ভিদ হিসেবে রোপণ করা হয়। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠের ২০০ থেকে ১ হাজার ২০০ মিটার উচ্চতায় এই ফুল স্বাভাবিকভাবে জন্মে।