আলোঝলমল শীতের বাগান

শীতের সবকিছুই অন্য ঋতু থেকে আলাদা। রাতের কুয়াশা, ভোরের শিশির, দিনের মিষ্টিমধুর রোদ, বিকেলের বিষণ্ন আলো আর সন্ধ্যায় পাতলা সরের মতো কুয়াশার মায়াবী মেখলা—এসবই শীতের অনুষঙ্গ। শীতের আলোঝলমল রোদ আমাদের মনকে উতলা করে। এই রোদের ভেতর লুকিয়ে থাকে ভ্রমণের যাবতীয় উন্মাদনা।

দিনপঞ্জির পাতায় নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বর উঁকি দিতেই আমাদের মন আর ঘরে থাকে না। বিল-ঝিল, বন-অরণ্য, গাঁও-গঞ্জ পেরিয়ে কত জনপদ যে ঘুরে বেড়ায় তার কি শেষ আছে? কড়ামিঠে রোদ গায়ে মেখে, গাঁয়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে গৃহস্থের রসুইঘর থেকে ছড়িয়ে পড়া ধনেপাতার ধোঁয়া ওঠা সালুনের ঘ্রাণ নিতে নিতে এই দিনগুলো ফুরিয়ে যায় দ্রুত। শীতের দিগন্তজোড়া শস্যভূমিও স্বপ্নের মতো। মাঠে রংবেরঙের বিচিত্র ফসলের মেলা মায়া-মুগ্ধতায় ভরা। এই শস্যভূমি শুধু মনের নয়, চোখের খোরাকও জোগায়। এসব মাঠে আছে ডাল, কাউন, পেঁয়াজ, রসুন, গম, ভুট্টা, গাজর, কপি, আলু, শিম—আরও কত কী! আর আছে দিগন্তজোড়া শর্ষেখেত। দিনের উজ্জ্বলতা শেষে যে রং ক্রমেই মিশে যেতে থাকে বিকেলের মায়াবী আলোয়।

গ্রামের মতো কি নগরজীবনে এভাবে শীতকে উদ্‌যাপনের সুযোগ আছে? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবার জানা। তাই শহরে শীতের প্রকৃতিকে উপভোগ্য করতেই শীতবাগানের সূচনা। শীতের বিবর্ণ প্রকৃতির বিপরীতে মৌসুমি ফুলের বাগানগুলো বেশ আলোঝলমলে, বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য। বিচিত্র রঙের ফুলে ফুলে ভরে ওঠে চারপাশের বাগানগুলো। ঢাকায় শীতের মৌসুমি ফুলের উল্লেখযোগ্য বাগান রমনা নার্সারি, জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণ, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল প্রাঙ্গণ ইত্যাদি। এ ছাড়া অনেক সুপরিসর অফিস প্রাঙ্গণেও শীতের বর্ণাঢ্য ফুলের প্রদর্শনী দেখা যায়। শীতের এসব বীথিবদ্ধ বাগান ক্ষণিকের জন্য হলেও মুগ্ধতা ছড়ায়।

আমাদের দেশে এসব ফুলের অধিকাংশই এসেছে শীতের দেশ থেকে। তবুও কয়েক জাতের ফুল আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে দারুণভাবে। রংবেরঙের এসব ফুলের মধ্যে আছে গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস, সালভিয়া, ভারবেনা, ডায়ানথাস, ক্যালেন্ডুলা, পপি, অ্যাস্টার, জিনিয়া ইত্যাদি। বর্ণবৈচিত্র্যের কারণে অ্যাস্টার সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয় ফুল। এ ফুলের অনেক রং—নীল, রক্তলাল, সাদা, গাঢ় লাল, হলুদ ও বেগুনি। তবে নীল অ্যাস্টার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন। ডালিয়া মৌসুমি ফুলের মধ্যে সবচেয়ে নজরকাড়া। এ ফুলের বিচিত্র গড়ন আর রঙের শেষ নেই। পাপড়ির সংখ্যাও অনেক। চন্দ্রমল্লিকার জন্মস্থান চীন আর সমাদর জাপানে। কারণ, চন্দ্রমল্লিকা জাপানের জাতীয় ফুল।

গোলাপের মতোই এ ফুলের কয়েক হাজার রকমফের চোখে পড়ে। বোতামের আকৃতি থেকে শুরু করে ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত চওড়া হতে পারে। পাপড়িও তেমনি হরেক রকম—কিনারগুলো লম্বা, উঁচানো, মোড়ানো, ছড়ানো, সরু বা চ্যাপটা। আমাদের দেশে বিক্ষিপ্তভাবে শার্লি পপির চাষ হয়। ফুল ৬০ সেন্টিমিটার চওড়া, আয়তাকার, দেখতে অনেকটা বড় পেয়ালার মতো। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে হলুদ রঙের ক্যালিফোর্নিয়ান পপি। কমলা বা হলুদ রঙের ক্যালেন্ডুলা দেখতে বেশ নজরকাড়া। শীতের বাগানে লাল টুকটুকে রং ছড়ায় সালভিয়া। আবার লুপিনের নীলাভ স্নিগ্ধতাও শীতের বাগানকে মাতিয়ে রাখে সারাক্ষণ। শীতের বাগানে আরও আছে স্ট্র-ফ্লাওয়ার, কর্নফ্লাওয়ার, হলিহক, জারবেরা, হরেক রঙের পিটুনিয়া, ভারবেনা, ফ্লক্স, কসমস, স্ন্যাপড্রাগন, ন্যাসটারশিয়াম ইত্যাদি। গত এক দশকে এই ফুলের মিছিলে আরও যুক্ত হয়েছে স্টুয়ার্ট ডেজার্ট পি, সুইট উইলিয়াম, লিলিয়াম, টিউলিপ, নার্সিসাস ইত্যাদি।

  • মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক