সাতছড়ি-লালাখালের দুই রূপসী ফুল

বিসকপরা ফুলের ছবিটি সম্প্রতি সিলেটের লালাখাল টি-গার্ডেন ঘাট থেকে তোলাছবি: যায়েদ আমীন

হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে কয়েকবার যাওয়া হলো। অন্য বনগুলোর তুলনায় এখানকার অভিজ্ঞতা চমকপ্রদ। সুবিশাল অবয়বের বৃক্ষ যেমন দেখেছি, তেমনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদও দেখেছি। সর্বশেষ গেলাম প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা ‘তরুপল্লব’ আয়োজিত ৩৪তম গাছ চেনানোর অনুষ্ঠানে।

আমরা যখন একটি ট্রেইল ধরে গাছ চিনতে ও চেনাতে ব্যস্ত, তখনই চোখে পড়ল গাছটি। কাণ্ড ও পাতার কোলভর্তি অসংখ্য ফুল। গাছটি আগেও দেখেছি। তখন ফুল ছিল না। উদ্ভিদবিদ শামসুল হক নিশ্চিত করলেন, গাছটি স্থানীয়ভাবে ‘জাতেরি বড়মালা’ নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Gomphostemma parviflorum

শাখা-প্রশাখাবহুল, সুগন্ধি বীরুৎ শ্রেণির গাছ। কখনো কখনো গুল্ম আকৃতির ঝোপালো ধরনেরও হতে পারে। কাণ্ড কাষ্ঠল ও অতিরোমশ। পাতা সবৃন্তক, পাতার বৃন্ত ২ থেকে ৪ সেন্টিমিটার লম্বা, অতিরোমশ, ফলক ১৫ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার, উপবৃত্তাকার থেকে ডিম্বাকার ও কিনারা দাঁতের মতো অসমান।

পাতার আগা তীক্ষ্ণ ও দীর্ঘ, ওপরের পিঠ কুঞ্চিত ও রোমাবৃত, নিচের পিঠ সাদা ঘন ক্ষুদ্র কোমল রোমে আবৃত। কাণ্ডের আয়তাকার গিঁট থেকে চারপাশে হলুদ রঙের নলাকার বা টিউবের মতো ফুল পর্যায়ক্রমে ফোটে। দুই থেকে আড়াই সেন্টিমিটার লম্বা, খাড়া, বাইরে কিছুটা রোমশ ও হলুদ। মঞ্জরিপত্র এক থেকে দেড় সেন্টিমিটার লম্বা, দেখতে বল্লমের মতো। বৃতি এক থেকে দেড় সেন্টিমিটার লম্বা, সাদাটে ও ঘন ক্ষুদ্র কোমল রোমাবৃত।

শরৎ-হেমন্ত এই ফুলের প্রধান মৌসুম। সাধারণত বনতল, ছায়াযুক্ত স্থান, পরিত্যক্ত জায়গা ও পাহাড়ের ঢালু অংশে এ গাছ জন্মে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ-এ বলা হয়েছে,Ñ‘আমাদের দেশে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, গাজীপুর ও সিলেট জেলায় গাছটি প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। এ গাছের পাতা পেস্ট করে কপালে লাগালে মাথাব্যথা উপশম হয় বলে লোকজ বিশ্বাস রয়েছে। বীজ থেকে বংশবৃদ্ধি ঘটে। আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে গাছটি এখন হুমকির মুখে।’

বিসকপরা বা বোগাসেরা কান্তা

সিলেট সীমান্ত লাগোয়া খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় উদ্ভিদবৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। লালাখাল হচ্ছে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এই শৈলসারির অন্যতম অনুষঙ্গ। খালটি পর্যটনের জন্য বিখ্যাত হলেও বৃক্ষপ্রেমীদের কাছে মূলত এর প্রধান আকর্ষণ দুই পাশের বিপুল, বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদরাজি। অনেকেই খালের দুই পাশের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ দেখতে এখানে আসেন। সম্প্রতি সেখানকার টি-গার্ডেন ঘাটের কাছে দেখা মিলল নান্দনিক এই ফুলের। বৃক্ষপ্রেমী যায়েদ আমীন ফুলটির প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন প্রথমে। দূর থেকে দেখে ভেবেছিলাম, কুচাই। ফুল ও গাছের গড়ন কুচাই ফুলের সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ। পরে দেখি, আরেক রকম ফুল, নাম বিসকপরা। স্থানীয়ভাবে ‘বোগাসেরা কান্তা’ নামেও পরিচিত। তবে কুচাই ফুলেরই আত্মীয়, একই পরিবারের উদ্ভিদ। বৈজ্ঞানিক নাম Mezoneuron cucullatum

এগুলো কাষ্ঠল আরোহী বা ছোট ধরনের উদ্ভিদ। সারা গা পশ্চাৎমুখী বাঁকা কাঁটায় ভরা। পাতা যৌগিক, অনুপপত্রী, পত্রক অক্ষ ১২ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা, পত্রক ৪ থেকে ৫ জোড়া, প্রতিমুখ, ডিম্বক-উপবৃত্তাকার, মূলীয় অংশ গোলাকার ও অসম, পাতলা চামড়ার মতো, উপরিভাগ চকচকে এবং বৃন্ত ৩ থেকে ৫ মিলিমিটার লম্বা। পুষ্পবিন্যাস সরল, অক্ষীয়, ১৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা ও রোমবিহীন। প্রায়ই পুরোনো কাণ্ড থেকে ফোটে। ফুলের রং উজ্জ্বল হলদে, সহপত্রী, মঞ্জরিপত্র আশুপাতী।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে জাতেরি বড়মালা ফুল
ছবি: লেখক

বৃতি ১ সেন্টিমিটার লম্বা, গভীরভাবে খণ্ডিত, বৃত্যাংশ পাঁচটি, সর্বনিম্নটির শীর্ষ সাপের ফণার মতো এবং বাকি ৪টি বৃতাংশ থেকে অপেক্ষাকৃত বড়। পাপড়ি পাঁচটি, উজ্জ্বল হলদে, ধ্বজক বেগুনি লাল, দ্বিখণ্ডিত, প্রজাপতি আকৃতিবিশিষ্ট, দুই থেকে আড়াই সেন্টিমিটার লম্বা। পুংকেশর ১০টি, একটি পুংদণ্ড অন্যগুলো থেকে দীর্ঘতর, পাঁচটি খাটো এবং মূলীয় অংশ রোমশ, পরাগধানী লাল। ফল শিমের মতো, পাতলা লালাভ বাদামি। ফুল ও ফলের মৌসুম জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস।

সাধারণত চিরহরিৎ অরণ্য, জলাশয়ের কিনারা, খালের নিকটবর্তী অঞ্চল এ গাছের আবাসস্থল। দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট জেলায় এ গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। তবে আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে সংখ্যায় অনেক কমেছে।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক