আসামের ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য বিশেষ বার্তা দিচ্ছে: বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার

অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারছবি: সংগৃহীত

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আজ রোববার বিকেল ৫টা ১১ মিনিটে অনুভূত হয় ভূমিকম্প। একে মাঝারি থেকে ভারী মাত্রার ভূমিকম্প বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রুবাইয়াত কবীর আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ৫ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে।’

এই ভূমিকম্পের প্রভাব কী বাংলাদেশের ওপর, বাংলাদেশের শঙ্কার জায়গাগুলো কোথায়, ঢাকায় এবার কি ভূমিকম্পের সময় বেশি ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে, রাজধানীর কোন এলাকায় কম্পন কতটা অনুভূত হয়, এর কারণই–বা কী—এসব নানা বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার। আজ হওয়া ভূমিকম্প নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো:

আজকে কিছুক্ষণ আগে যে ভূমিকম্পটা হলো, সেটা বাংলাদেশ সময় ৫টা ১১ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে সংঘটিত হয়। যেখানে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে, সেটা ঢাকা থেকে ৩৮০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতের আসাম রাজ্যের আসাম ভ্যালিতে অবস্থিত। ওই এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদ প্রবাহিত হচ্ছে, তার একটু উত্তরেই এই উৎপত্তিস্থল। ভারতের অরুণাচল প্রদেশের কাছাকাছি এবং হিমালয়ান ফ্রন্টাল থ্রাস্টের মধ্যে পড়েছে। হিমালয়ান ফ্রন্টাল থ্রাস্ট (এইচএফটি) আবার মেইন ফ্রন্টাল থ্রাস্ট (এমএফটি) নামেও পরিচিত। এটি হিমালয়ের সম্মুখভাগে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূতাত্ত্বিক ফল্ট বা ভাঙনরেখা, যা হিমালয়ের পাদদেশ ও ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমির সীমানা নির্দেশ করে। এখানে ইন্ডিয়ান প্লেট হিমালয়ের নিচে অর্থাৎ এশিয়া প্লেটের নিচে যেখানে তলিয়ে যাচ্ছে, সেই অংশে ভারতীয় প্লেটের মধ্যে এবারের ভূমিকম্প সংঘটিত হলো। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৯। এর গভীরতা ছিল ৩৫ কিলোমিটার।

এই ভূমিকম্প বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের অনেক স্থানেই কমবেশি অনুভূত হয়েছে। উত্তর–পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম, বিহার এবং নেপাল ও ভুটানেও অনুভূত হয়েছে।

‘আমরা গবেষণায় দেখেছি যে বাংলাদেশের ভূমিকম্পের দুটি উৎস আছে। একটি উত্তরের দিকে আছে, আরেকটা হচ্ছে পূর্ব দিকে। উত্তরের দিকটা হলো ডাউকি ফল্ট (ডাউকি চ্যুতি)। আজকে যে ভূমিকম্প হলো, সেই হিমালয়ন মেইন ফ্রন্টাল থ্রাস্ট বেল্টে। সেটা আমাদের ভূমিকম্পের আরেকটি উৎসস্থল ডাউকি ফল্টেরই কাছাকাছি।’

বাংলাদেশের ভূমিকম্পের দ্বিতীয় উৎসস্থল হলো পূর্বে। এটাকে বলে ইন্দোবার্মা সাবডাকশম জোন। যেটা সিলেট থেকে শুরু করে কক্সবাজার ও টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত।

‘উত্তর ও পূর্ব—এই দুই উৎসের মধ্যে সিলেট থেকে কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম পর্যন্ত এই অংশটা খুব বিপজ্জনক। কেননা এখানে হাজার বছরের ওপরে বড় ভূমিকম্প হয়নি। অর্থাৎ যে শক্তিটা জমা হয়ে রয়েছে বা ক্রমাগত জমা হচ্ছে, গত এক হাজার বছরেও এটা শক্তিটা ছাড়েনি। এটা যেকোনো সময় বড় আকারের ভূমিকম্পের স্থান হয়ে উঠতে পারে। আমরা গবেষণায় দেখেছি, এখানে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়ে আছে। আর এটি যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে।

‘উত্তরে যেখানে ভূমিকম্প সংঘটিত হলো, সেখানে বড়জোর সাত সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে আজকে যেখানে হলো, সেখানে শক্তি রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এসব এলাকায় ছয় থেকে সাড়ে ছয় মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা খুব কম। এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা নেই। যে স্থানটাতে এই শক্তি রূপান্তরিত হয়ে আসছে, সেঠা কিন্তু ঢাকা থেকে মাত্র দেড় শ কিলোমাটির বা এর বেশি দূরে। এখানেই ভয়টা বেশি। ডাউকি ফল্ট নিয়ে আমাদের ভাবনা থাকলেও এর সঞ্চিত ও রূপান্তরিত শক্তি নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে ভূমিকম্প। আর সেটি আমাদের নিকটবর্তী হচ্ছে।’

ঢাকায় ঝাঁকুনি বেশি অনুভূত হলো কেন

বাংলাদেশে তো পলিমাটির দেশ। ঢাকার বড় অংশ পলিমাটির ওপর দাঁড়িয়ে। ঢাকার ভেতরে আবার লাল মাটি আছে, যেটা খুব ‘কম্প্যাক্টেড রেড ক্লে’। আবার কিছু ডোবা আছে, যেগুলো ভরাট করে বসত বা কোনো নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে পলিমাটি, সেখানে একটু ঝাঁকুনি লাগবে বেশি। ঢাকার একটু বাইরে যেমন বাসাবো বা রায়েরবাজার, ওখানে লাল মাটি নেই, সেখানে পুরোটাই পলিমাটি। এসব এলাকায় ঝাঁকুনি বেশি লাগার আশঙ্কা থাকে। সাভার বা ঢাকার মিরপুর লাল মাটির অঞ্চল। এসব এলাকায় ঝাঁকুনি কম অনুভূত হওয়ার কথা। ঢাকার একটি বড় অংশজুড়ে ডোবা এলাকা ভরাট করে বসতবাড়ি করা হয়েছে। সেসব অঞ্চলেও ভূমিকম্প বেশি অনুভূত হয়।

আরও পড়ুন

এই ভূমিকম্প কী বার্তা দেয়

‘এই ভূমিকম্প আমাদের এই বার্তা দেয় যে আমাদের দ্বারপ্রান্তে যে উৎস রয়েছে উত্তরে, সেখানে যেকোনো সময় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে আর সেটা বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। সেটা কখন হবে, সেটা জানি না। তবে আমাদের এই ব্যাপারে মানে জনগণকে অধিক সচেতন হওয়া এবং ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য প্রস্তুতির দরকার আছে। আমি সব সময় যেটা বলে আসি, সেটা হচ্ছে ভূমিকম্পের মহড়ার কোনো বিকল্প নেই, সেটা জরুরি। কিন্তু মহড়া এখন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে পড়ে গেছে। বাস্তব অর্থে মহড়া হয় না বললেই চলে।’