জলচর পাখিদের ছবি তোলার জন্য ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল জলাভূমি অভয়ারণ্যে এসেছি। পুরো সকালটা বিলে ঘুরে ঘর্মক্লান্ত দেহে দুপুরের কড়া রোদে পাশের পুকুর ও খালের মাঝখানের রাস্তাটি দিয়ে ধীরপায়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ খালের অন্য পাড়ে ঢোলকলমির ঝোপ থেকে খয়েরি-কালো এক পাখি বেরিয়ে এসে ঝোপের ওপরে ডানা মেলে রোদ পোহাতে লাগল। কী চমৎকার সে দৃশ্য! এমন দৃশ্য খুব কমই দেখেছি। কাজেই একটুও সময় নষ্ট না করে দ্রুত পাখিটির ছবি তুলতে থাকলাম। এই ঝোপ থেকেই পাখিটিকে প্রথমবারের মতো উড়ে যেতে দেখেছিলাম ২০১২ সালে। এরপর ২০১৯ সালের নভেম্বরে কক্সবাজারের ইনানিতে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে পাখিটিকে উড়ে যেতে দেখলাম। ডিসেম্বর ২০২০-এ ওকে আবারও দেখলাম রাজশাহীর পদ্মা নদীর চর মাজারদিয়ারে। কিন্তু প্রতিবারই ছবি তুলতে ব্যর্থ হই। বাইক্কা বিলের পর নিয়মিতভাবে ওর ছবি তুলেছি কমলগঞ্জের কুরমা পক্ষী অভয়াশ্রম থেকে।
২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি গোলবনের সুন্দরী হাঁসপাখির ছবি তুলে সুন্দরবন থেকে ফিরছিলাম। পথে সুন্দরী ও হাড়বাড়িয়া খালের পাড়ে কিছুক্ষণ পরপরই লালচে-খয়েরি ও কালো রঙের বড় আকারের হাঁড়িমুখো আরেক পাখির সঙ্গে দেখা হচ্ছিল। পাখিটিকে সব সময়ই গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দেখি। সবশেষ ওকে দেখলাম ভোলার চর কুকরিমুকরি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে যাওয়ার পথে এক খালের পাড়ে। পাখিটি নিয়ে বাগেরহাটে এ রকম একটি পাখিপুরাণ প্রচলিত রয়েছে—
সত্যযুগে এক গ্রামে ছিল এক গেরস্ত। তার ছিল একটিমাত্র ছেলে। ছেলেটি সাঁতার জানত না। একদিন সে পানিতে পড়ে ডুবে মারা গেল। গেরস্ত এ কথা জানতে পেরে শোকে কাঁদতে লাগল। সে ‘সত্যর গাছে’র কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, পুতহীন জীবন নিয়ে কী করবে? সে আর বেঁচে থাকতে চায় না। ভগবান তার মনস্কামনা পূরণ করলেন। গেরস্ত মরে গিয়ে লাল-কালো কানাকুক্কা পাখি হয়ে গেল। কিন্তু মৃত ছেলের কথা আজও সে ভোলেনি। তাই চোখ লাল করে হাঁড়ির মতো মুখ করে আজও নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ায়। নদীতে যখন জোয়ার-ভাটা আসে, তখনই এই বলে ডাকে—‘ভাটায় রাখলাম পুত, জোয়ারে নিল পুত, পুত-পুত-পুত।’
প্রথম গল্পের ছোট আকারের পাখিটি এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখি ছোট কানাকুক্কা। ছোট কুকো, কুক্কা বা ছোট কুবো (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম বেঙ্গল বা লেসার কুকাল। বৈজ্ঞানিক নাম Centropus bengalensis। পাকিস্তান ও মালদ্বীপ ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ চীন, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশে দেখা মেলে।
দ্বিতীয় গল্পের অপেক্ষাকৃত বড় আকারের পাখিটি এ দেশের বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি বড় কানাকুক্কা। আমার গ্রামে এটি আইড়ামোক্কা বা হাঁড়িমুখো নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম গ্রেটার কুকাল, কুকাল বা বাংলাদেশ ক্রো-ফিজ্যান্ট। বৈজ্ঞানিক নাম Centropus sinensis। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে দক্ষিণ চীন হয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ওরা বিস্তৃত।
ছোট কানাকুক্কা বড় কানাকুক্কার ক্ষুদ্র সংস্করণ। প্রজাতিনির্বিশেষে বড় ও ছোট কানাকুক্কার স্ত্রীগুলো পুরুষের তুলনায় আকারে লম্বা ও ওজনে ভারী। দৈর্ঘ্যে পুরুষ ছোট কানাকুক্কা ৩১ সেন্টিমিটার ও স্ত্রী ৩৪ সেন্টিমিটার ও ওজনে ৮০ থেকে ৯২ গ্রাম। অন্যদিকে বড় কানাকুক্কা দৈর্ঘ্যে ৪৭ থেকে ৫২ সেন্টিমিটার ও ওজনে পুরুষ ২৩৬ গ্রাম ও স্ত্রী ২৬৮ গ্রাম।
ছোট কানাকুক্কা মিশ্র চিরসবুজ বা পত্রঝরা বন, বনের চারপাশ, জলার চারপাশ, জলার পাশের ঝোপজঙ্গল ও ঘাসবনের বাসিন্দা। অন্যদিকে বড়টি দেশজুড়ে বিস্তৃত ঘাসবন, চষা জমি, ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাভূমি, বাদাবন প্রভৃতিতে বিচরণ করে। উভয়েই একাকী বা জোড়ায় থাকে। ঘাসফড়িং, কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ, ব্যাঙ ইত্যাদি প্রিয় খাবার। তবে বড়টি সাপ ও পাখি শিকার করে।
ছোটটির প্রজননকাল মার্চ থেকে অক্টোবর, বড়টির জুন থেকে আগস্ট। এরা সারা জীবনের জন্য জোড় বাঁধে। আয়ুষ্কাল প্রায় চার বছর।