বান্দরহুলার দেখা পেলাম

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে বান্দরহুলা বৃক্ষছবি: লেখক

গত জানুয়ারিতে একদিন গিয়েছিলাম ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে; কোন কোন উদ্ভিদে ফুল ফুটেছে দেখা আর ছবি তোলা ছিল উদ্দেশ্য। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের এই গার্ডেন পুষ্প, বৃক্ষ, লতাগুল্মে খুব সমৃদ্ধ। প্রকৃতিতে শীতের আমেজ। গাছের পাতা ঝিরঝিরে বাতাসে নড়ছে। প্রকৃতি চুপ করে আছে। দর্শনার্থীদের সমাগমও কম। প্রধান গেট দিয়ে ঢুকে ডান দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রথমে গেলাম স্বর্ণ–অশোকগাছের পাশে।

তারপর শিবলিঙ্গ পানির ট্যাংকের কাছে। দেখতে শিবলিঙ্গের মতো বলে ট্যাংকটি এই নামে পরিচিত। এই ট্যাংকের পাশে কয়েকটি পাখিফুল গাছে। পাতার ফাঁকে সুন্দর কলি ও ফুলের গুচ্ছ চোখে পড়ল। সে স্থান অতিক্রম করে আরও পুব দিকে এগিয়ে গেলাম। এদিকটাতে এর আগে আর আসিনি। একটা খোলা জায়গায় পৌঁছে গেলাম এরপর। পশ্চিম পাশে দেখলাম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক গাছ। তার শীর্ষদেশ থেকে অনেকগুলো শাখা নেমে এসেছে মাটির কাছাকাছি। যেন অক্টোপাসের পা। শাখার শীর্ষে পুষ্পমঞ্জরি। চিনে গেলাম এ যে বান্দরহুলা বৃক্ষ! ছবি তুলে নিলাম ঝটপট।

ভারত, নেপাল, দক্ষিণ চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও মালয়েশিয়ায় এই বৃক্ষ সহজলভ্য। আমাদের দেশের বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে পাওয়া যায়। বানর এ গাছে দোল খেতে পছন্দ করে বলেই হয়তো এ গাছের নাম বান্দরহুলা।

বান্দরহুলা বড় আকারের চিরসবুজ বৃক্ষ, ৪৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Duabanga grandiflora (সমনাম Duabanga sonneratioides), এটা Lythraceae পরিবারের উদ্ভিদ। এর সাবেক পরিবারের নাম Sonneratiaceae, বান্দরহুলার অন্য নামগুলো হচ্ছে বান্দরহুলা, বান্দরফুল্লা, কচা, লামপাতি ও রামডালু। বান্দরহুলার পাতা সরল, ১৮-৩৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়, একান্তর ও পূর্ণাঙ্গ। ফুলের বৃতি কাপ আকৃতির, ফুল সাদা ও বড়। ফল ক্যাপসুল, ফলে চার থেকে আটটি প্রকোষ্ঠ আছে। স্কটিশ উদ্ভিদবিদ, সার্ভেয়ার ও সার্জন ফ্রান্সিস হ্যামিল্টন (১৭৬২-১৮২৯) ত্রিপুরার স্থানীয় নাম দুয়াবাঙ্গা থেকে Duabanga নামটি নিয়েছিলেন। হিমালয়ের নদী বা জলপ্রবাহের ধারে সাধারণত এই গাছ পাওয়া যায়।

ভারত, নেপাল, দক্ষিণ চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও মালয়েশিয়ায় এই বৃক্ষ সহজলভ্য। আমাদের দেশের বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে পাওয়া যায়। বানর এ গাছে দোল খেতে পছন্দ করে বলেই হয়তো এ গাছের নাম বান্দরহুলা।

এই বৃক্ষের কাণ্ড খাড়া, কখনো কখনো গোড়া থেকে কাঁটাযুক্ত। বৃক্ষের শীর্ষদেশ থেকে লম্বা, সরু শাখা নিচের দিকে ছড়িয়ে পেন্ডুলামের মতো ঝুলে থাকে। বৃক্ষ অল্প শাখাযুক্ত এবং শাখাগুলো চারকোনাযুক্ত। শাখাগুলো ঢিলেঢালাভাবে বড় ছড়ানো পাতা দিয়ে আবৃত। পাতার বিন্যাস বিপরীত তির্যকাপন্ন অর্থাৎ এক জোড়া পাতার ওপরের জোড়ার ঠিক ওপরে না থেকে একটু তির্যকভাবে থাকে। কচি অবস্থায় পাতা লাল থাকে। পাতা আয়তাকার, ওপরে চকচকে, নিচে অনুজ্জ্বল। পাতা ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ১০ সেন্টিমিটার চওড়া। পাতার অক্ষে এবং শাখার শেষে ফুল বের হয়। পুষ্পবিন্যাস করিম্ব, শাখার প্রান্তে ঝুলে থাকে। প্রতিটি পুষ্পমঞ্জরিতে ৩ থেকে ২০টি ফুল থাকে। প্রতিটি ফুল বড়, ৫-৬ সেন্টিমিটার, রঙে সাদা এবং দুর্গন্ধযুক্ত। বৃতির গঠন খুবই পুরু, ঘণ্টা আকৃতির এবং স্থায়ী।

ছয়টি পাপড়ি শিগগিরই পড়ে যায়। পুংকেশর অনেক। বড় ফুল এপ্রিলে বিস্তৃত হয়, প্রথমবার ফেটে যাওয়ার সময় হিংয়ের মতো গন্ধ বের করে, কিন্তু পাপড়ি ঝরে পড়ার আগেই সেগুলো দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যায়। পুংকেশরগুলো সব কুঁড়িতে ভেতরের দিকে বাঁকানো থাকে। ফল অর্ধগোলাকার, ক্যাপসুল, প্রায় একটি ছোট কমলালেবু বা আপেল আকৃতির। ফল পরিপক্ব হলে ৬-৯ খণ্ডে ফেটে যায়। বীজ থেকে চারা হয়।

কাঠ মোটামুটি শক্ত, দৃঢ়, হালকা ও টেকসই। পানিতে ভালো টেকে। ভালোভাবে পালিশ করা যায় বলে প্রথম শ্রেণির কাঠ হিসেবে বান্দরহুলা কাঠকে বিবেচনা করা হয়। এ কাঠ ডোঙা, নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ, ঘরের আদল-বোয়া, তক্তা, পাটাতন, আসবাব ও দেশলাইয়ের কাঠি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

  • চয়ন বিকাশ ভদ্র, অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান প্রকৃতিবিষয়ক লেখক