সুন্দরবনে বিরল অর্কিডের খোঁজে

ছোট বাল্ব অর্কিড, মহাবিপন্ন এই অর্কিডের ছবি তোলা হয়েছে হরিণটানা খাল থেকে
ছবি: গাজী মোশারফ হোসেন

গত বছর প্রচণ্ড গরমের ভেতর গবেষণাকাজে সুন্দরবন গেলাম। এ রকম গরমে বন্য প্রাণীর নড়াচড়া কম চোখে পড়ে। তাই প্রাণীর দেখাও কম পেলাম। তবে এই মৌসুমটায় বাদাবনের বিভিন্ন গাছে ফুল ফোটে। রঙিন পাতায় বনটা হয়ে ওঠে বড়ই আকর্ষণীয়। ভ্রমণটিকে তাই প্রাণময় করার জন্য বিরল সব গাছের সন্ধান করতে লাগলাম। মূলত আমার নজর অর্কিড প্রজাতির গাছের দিকে।

এ যাত্রায় সঙ্গে আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গাজী মোশারফ হোসেনসহ একদল উদ্ভিদবিজ্ঞানী। কোনো গাছে অর্কিড দেখলেই তাঁদের কাছে চেনার জন্য বিভিন্ন প্রশ্ন করলাম। মাত্র কয়েক দিনেই বিরল কয়েকটি অর্কিডের সন্ধান মিলল। এর আগে সুন্দরবন ভ্রমণে কখনোই এই অর্কিডগুলো আমার চোখে পড়েনি। অর্কিডপ্রেমীরা সঙ্গে আছেন বলেই কাজটি সহজ হলো। সুন্দরবনে একটি ভ্রমণ যে অর্কিড দেখেই কাটিয়ে দেওয়া যায়, তা আগে কখনোই ভাবিনি।

সব জাতের অর্কিডই আমার প্রিয়। দেশি অর্কিড সংগ্রহের আশায় অনেক নার্সারিতে গেছি, কিন্তু খুব বেশি প্রজাতির দেখা পাইনি। প্রতিবছরই বৃক্ষমেলায় যাই। এখানে যা পাওয়া যায়, তার প্রায় সবই বিদেশি প্রজাতির অর্কিড। দেশি অর্কিডের কোনো চাহিদা নেই অথবা চারা উৎপাদন সহজ নয় বলেই এমন অবস্থা। দেশের ভেতর যে বনেই গেছি, দেশি অর্কিডের সন্ধান করেছি। সহজেই বনের ভেতর অর্কিডের দেখা পেয়েছি। কিন্তু সুন্দরবন ভ্রমণে বুনো অর্কিডের সন্ধান করার সময় সত্যিই বন্য প্রাণী দেখার মতোই উত্তেজনা অনুভব করেছি।

সুন্দরবনে প্রায় ১৯ জাতের অর্কিডের দেখা মেলে। এর মধ্যে প্রায় ১০ প্রজাতির অর্কিড সুন্দরবনের বাইরে দেখা যায় না বললেই চলে। আবার তিন জাতের অর্কিড আছে, যা একেবারেই বিশেষ। এদের দেখা পাওয়া একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার। ফুল ফোটাসহ এসব অর্কিডের দেখা পাওয়া বাঘ দেখার মতোই বিরল। এর মধ্যে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএনের লাল তালিকা অনুযায়ী দুটি প্রজাতি মহাবিপন্ন।

ছোট্ট বাল্ব অর্কিড ও বুলবোরক্স। আরেকটি প্রজাতির নাম ‘বড় একামপি অর্কিড’। এই প্রজাতি হলো বিপন্ন। এই তিন প্রজাতির অর্কিড দেখা পেয়েছি সুন্দরবনে গিয়ে। অন্য যেকোনো অর্কিডের চেয়ে এই অর্কিডগুলোর ফুল দেখে অভিভূত হয়েছি।

বড় একামপি অর্কিড, বিপন্ন এই অর্কিড প্রজাতি সুন্দরবনের পূর্ব বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে ও বিভিন্ন খালের পাশে গাছগুলোতে দেখা যায়
ছবি: গাজী মোশারফ হোসেন

সুন্দরবনের যেকোনো জায়গায় ঘুরলেই এসব অর্কিডের দেখা পাওয়া যায় না। একেবারেই নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলেই কেবল এদের দেখা মেলে। সুন্দরবন বন্য প্রাণী পূর্ব অভয়ারণ্যের সুপতি খাল, দুধমুখী, হরিণটানা থেকে কটকা পর্যন্ত বিভিন্ন খালের পাশে বিভিন্ন গাছে এই অর্কিডগুলোর দেখা মেলে। বর্ষার কিছু আগে ও বর্ষায় বেশির ভাগ সময় অর্কিডের ফুল ফোটে।

কাজেই এ সময়টায় গেলে বিরল সব অর্কিডের দেখা পাওয়া যায়। বেশির ভাগ অর্কিড জন্মায় সুন্দরীগাছে। সম্প্রতি গাজী মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি গবেষণা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, সুন্দরবনে এসব অর্কিডের ফুল খুব ভালো হলেও ফল হয় কম।

এই ফল কম হওয়ায় অর্কিডের বীজও কম হচ্ছে। তাই তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি খুব বেশি হচ্ছে না। অন্যদিকে সুন্দরবনে সুন্দরীগাছের টপ ডাইং রোগসহ বিভিন্ন কারণে গাছটির সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। এই হোস্ট প্রজাতির গাছের সমস্যার কারণেও অর্কিডের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

সুন্দরবনের বড় সৌন্দর্য এই অর্কিড প্রজাতিগুলো। কিছু কিছু অর্কিড আছে, যা সুন্দরবনের বাইরে পৃথিবীর খুব কম জায়গায় দেখা যায়। এত মূল্যবান অর্কিডগুলোর প্রতি আমরা নজর দিতে পারিনি।

গবেষকেরা বলছেন, অর্কিডের জন্য যদি সুন্দরবনের নির্দিষ্ট জায়গায় একটা ছোট্ট বিজ্ঞানসম্মত নার্সারি করা যায়, সেখান থেকে চারা নিয়ে নির্দিষ্ট অঞ্চলের গাছে প্রতিস্থাপন করে দেখা যেতে পারে তাদের বংশবৃদ্ধি হয় কি না। এই কাজটুকু বন অধিদপ্তরের নেতৃত্বে এখন শুরু করা যেতে পারে।

সুন্দরবনের অর্কিড ছাড়াও এ দেশে প্রায় ১৯০ জাতের অর্কিডের দেখা মেলে। বেশির ভাগ প্রজাতির অবস্থা বুনো পরিবেশে কেমন আছে, তা আমাদের জানা নেই। অর্কিডের ফুল নিয়ে গাছপ্রেমীদের আগ্রহের কমতি নেই, কিন্তু গবেষণায় আমরা সেভাবে এগোতে পারিনি। অর্কিডের ফুলের সৌন্দর্যে সুন্দরবন ভরে উঠুক, এই কামনা করি।

  • সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণী গবেষক