বর্ষণমুখর দিনে ফুলের উৎসব

কাঁঠালচাঁপা
ছবি: লেখক

বৃষ্টিভেজা এক অলস দিনের গল্প। তুমুল বৃষ্টি আর সাদা চাদরের মতো ভেসে থাকা বাতাসের ভেতর ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছাই জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার কাপাসহাটিয়া গ্রামে। গ্রাম এমনিতেই প্রিয়, তার সঙ্গে বাড়তি হিসেবে এখানে পেলাম গান্ধী আশ্রম, স্বাধীনতা জাদুঘর আর একটি নান্দনিক অতিথিশালা। সবই এক দেয়ালের ভেতর পাশাপাশি।

হাওরবেষ্টিত ছোট্ট এই জনপদ বর্ষায় দ্বীপের মতো। পথের দুপাশে কতকগুলো ঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে গ্রাম। এমন একটি মনোমুগ্ধকর স্থান কখনোই দেখা হতো না, যদি এই বিপুল কর্মযজ্ঞের অধিকর্তা হিল্লোল সরকার আমন্ত্রণ না জানাতেন। তিনি যে একজন খাঁটি বৃক্ষপ্রেমী তা বুঝতেও বেশি সময় লাগল না। ঢোকার পথে চোখে পড়ল দুর্লভ বিউমন্টিয়ার ঝাড়।

চালতা ফুল

গাছটি আমাদের বন-পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। নগর উদ্যানে আছে হাতেগোনা দু–একটি। এমন নিভৃত গ্রামে এই গাছ তিনি সংগ্রহ করলেন কীভাবে! ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে আকাশ।

ধুন্ধুমার বৃষ্টির ভেতর উপাদেয় আহারাদি সেরে রাতের ঘুমের প্রস্তুতি নিই। সন্ধ্যা গড়াতেই ঘুমিয়ে পড়ল পুরো গ্রাম। নিস্তব্ধ চারপাশে শুধু ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের ডাক। রাতের প্রথম প্রহরে আবার মধুর বৃষ্টি নামল। এই বৃষ্টিতে যেন মুহূর্তের জন্য থেমে গেল জগৎঘড়ি। এমন অপার্থিব সময় ঘিরে কিছুক্ষণ থেমে থাকুক না পৃথিবীর সব ব্যস্ততা!

উপভোগ্য রাত পেরিয়ে বৃষ্টিহীন সকালে ঘুম ভাঙল। প্রশস্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলাই। হাতের নাগালে অবারিত মাঠ। এমন একটি সম্ভাবনাময় সকালে পুষ্পসারথিরা আমাকে ডেকে নিয়ে গেল নিচের এক ঝলমলে উদ্যানে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু ফুল আর ফুল।

প্রতিটি গাছই সুদৃশ্য ফুলভরতি। বৃষ্টিভেজা গোলাপি জবা আর হেলিকোনিয়াগুলো হেসে আছে যেন। সাদা-শুভ্র নতুন প্লুমেরিয়া আর সাদা কাঞ্চন দেখতে দেখতে লিলিপুলের রক্তকমলগুলো পাপড়ি মেলে তাকাল। পাশেই বেগুনি রঙের শালুক ফুল। গাছভরতি চালতা ফুলের রাজসিক সৌন্দর্য এই আনন্দময় সকালকে পূর্ণতায় ভরিয়ে দিল।

লালঝুমকা

বর্ষায় একসঙ্গে এত ফুলের সমাবেশ খুব একটা চোখে পড়ে না। বেগুনি রঙের কাঁটামেহেদি ফুলের ঝাড়ের পাশে উজাড় করে ফুটেছে ট্রাম্পেট ক্রিপার, নীল অপরাজিতা, অনন্তলতা, লাল আর বেগুনি ঝুমকো, বেলি, কাঁঠালচাঁপা, বাগানবিলাস, মধুমঞ্জরি, মাধবী, মালতী, তুঁত, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, বটলব্রাশ, পাখিফুল, চামেলি, নীলচিতা, হলুদ শাপলা, কলাবতী, কামিনী, পদ্ম, সুষমা, বনপিটুনিয়া, ব্লিডিং হার্ট, অ্যারোমেটিক জুঁই, রসুন্দি, বাসরলতা, বাসক, স্থলপদ্ম, নীলমণিলতা আরও কত কী! দুপাশে আছে বড় গাছÑকুরচি, পলাশ, পুত্রঞ্জীব, হরীতকী, ফুরুস, আমলকী, বহেড়া, শিউলি, উদয়পদ্ম, কতবেল, লটকন, হিজল, বকফুল, জারুল, সোনালু, বরুণ, গামারি, পবনঝাউ, তেজপাতা, কাজুবাদাম, তেঁতুল, জলপাই, মহুয়া, কাঠবাদাম, কদম, বকুল, মণিমালা, শিমুল ও স্টার আপেল।

সব মিলিয়ে এখানে দেড় শতাধিক বিচিত্র উদ্ভিদের বিস্ময়কর সংগ্রহ গড়ে উঠেছে। ভাবতে অবাকই লাগছে দুর্গম এই জনপদে কতটা অভিনিবেশ থাকলে এমন উদ্ভিদবৈচিত্র্য গড়ে তোলা সম্ভব। সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি মাধবী, মালতী, কুরচি, চামেলি, নীলমণিলতা, হলুদ শাপলা বা মণিমালার মতো দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদের সংগ্রহ দেখে। এসব উদ্ভিদের চারা-কলম সহজলভ্য নয়।

এই পুষ্পায়োজনের নেপথ্য কারিগর যে হিল্লোল সরকার, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জামালপুর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে এমন একটি গ্রামে কীভাবে এসব সম্ভব হলো, হিল্লোল সরকারের কাছ থেকে তা জানা গেল। তিনি জানান, উদ্ভিদের সঙ্গে তাঁদের এই সখ্য উত্তরাধিকার সূত্রে।

তাঁর দাদা নাসির সরকার ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী। গান্ধীবাদে দীক্ষিত মানুষটি এখানে গড়ে তুলেছিলেন গান্ধী স্মারক আশ্রম।

অবিভক্ত ভারতের বিখ্যাত অনেকেই এসেছিলেন এখানে। তাঁদের মধ্যে সত্যেন সেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, মণি সিং প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। প্রথমে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং পরে দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি ছিলেন তুমুলভাবে সক্রিয়। এসবের বাইরে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃতিবাদী বৃক্ষপ্রেমী। গ্রামজুড়ে থাকা আম, জাম, লিচুসহ এখানকার শতোর্ধ্ববর্ষী গাছগুলো তাঁর সেই অনন্য স্মৃতি বহন করে চলেছে।

পিতামহের এই পরম্পরা বহন করে চলেছেন চার সহোদর—দোদুল সরকার, চপল সরকার, কল্লোল সরকার ও হিল্লোল সরকার। মূলত তাঁদের উদ্যোগেই ২০০৮ সালের দিকে মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর’। যা পরবর্তী সময়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দৃষ্টিনন্দন একটি ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে। এবং এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এই জাদুঘরের পাশে অচিরেই যুক্ত হবে ঈশ্বরচন্দ্র গুহ প্রতিষ্ঠিত জামালপুরের ঐতিহ্য বিলুপ্ত ‘চৈতন্য নার্সারি’ স্মারক উদ্যান।

  • মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক