আবার হেমন্তের কাছে

গ্রামের ফসলের মাঠ–ঘাট–পথে কুয়াশা জানান দিচ্ছে হেমন্তের বার্তা। সিলেট সদরের নন্দিরগাঁও এলাকায় রোববার বিকেলে
ছবি: আনিস মাহমুদ

এ যেন বহুদিন পর কার্তিকের ভোরের ফিরে আসা। ‘কুড়ি বছর পরে’ কবিতায় জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছেন, ‘আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!/ আবার বছর কুড়ি পরে—/ হয়তো ধানের ছড়ার পাশে/ কার্তিকের মাসে...’

আবার এল কার্তিকের ভোর। মিষ্টি মিষ্টি ভালো লাগার সকাল। কার্তিকের পরে অগ্রহায়ণ—এই দুই মাস নিয়ে বাংলার চিরায়ত হেমন্ত।

হেমন্ত যেন প্রকৃতির আহ্লাদী কাঁচা সোনা রঙের মেয়ে, যে নববধূবেশে সেজেছে এই সংসারে। হেমন্তে ধান কাটতে কাটতে বাংলার কৃষক গান গেয়ে ওঠেন মনের হরষে। হেমন্ত তাই ধানকন্যা, হেমন্ত গানকন্যা।

কার্তিক এসেছে—কোনো না কোনোভাবে আমরা টের পেয়ে যাই। প্রকৃতিতে পালাবদলের কিছু না কিছু ঘটে। রাতের ফোঁটা ফোঁটা শিশির জমে থাকে ধানের পাতায়, শিষে। ঘাসের বুকে। গাছ থেকে দু-চারটি পাতাও ঝরে পড়ে ওইসব ঘাসের ওপর, পথে, উঠানে। এ তার ফেরার প্রকাশ, এ তার উদ্‌যাপনের চিহ্ন।

শরৎ গেছে—এটুকু বললেই চলে গেছে বলা যায় না। এখনো নদীপারে, বুনো পথে কাশফুল ফুটে আছে। এখনো মেঘ সরলেই আকাশ নীলের ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে হাসে। সাদা মেঘের দল উড়ে আসে। প্রকৃতি তো এমনই, একদম ঘড়ির কাঁটার ঘোর, যেই পথ—সেই বাঁধাধরা পথে তার চলে না।

গত বছর এ সময়ে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে শীত নেমে গিয়েছিল প্রায়। শীতের বার্তা ছড়িয়ে পড়েছিল হাওয়ায় ও গাছে, কুয়াশায়, সন্ধ্যায়। এবার সে চিহ্ন তেমন নেই। তবে রাত গভীর হলেই ঝরছে হালকা কুয়াশা। সকালের সবুজ ঘাস আর আমন ধানের কচি পাতায় জমছে শিশিরবিন্দু।

হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিক। একসময় বাংলার ঘরে ঘরে কার্তিক ছিল ‘মঙ্গা’র মাস, ছিল অভাবের মাস। সেই পরিচয়টুকু বেশ আগেই মুছে গেছে। কার্তিক এখন আর শুধুই মঙ্গার নয়, অভাবের নয়। মাঠে মাঠে ধানের শিষ ফুটছে, দানা বাঁধছে ক্ষীর। ধানের জেলা নওগাঁয় এখন মাঠে মাঠে সবুজের সমারোহ। দেখে মনে হয়, কেউ সবুজের গালিচা পেতে রেখেছে। বাতাসে দুলছে কচি ধানের শিষ। ফসলের মাঠের কোথাও ফাঁকা নেই, যত দূর দৃষ্টি পড়ে, সবুজ আর সবুজ। অধিকাংশ আমন খেতে ধানগাছগুলোয় এখন শিষ বের হতে শুরু করেছে।

শরৎ শেষ হয়ে এসেছে হেমন্ত। প্রকৃতিতে তবু শরতের এই রেশ থেকে যাবে আরও কিছুদিন। কাশফুলে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে একঝাক ‘বাংলা-বাবুই’। চর সদিরাজপুর, পাবনা, ১৫ অক্টোবর
ছবি: হাসান মাহমুদ

এই তো কিছুদিনের মধ্যে ধানখেত সোনালি হয়ে উঠবে ভোরের আলোয়। অগ্রহায়ণ তো পুরোপুরিই ধান কাটার মাস। তখন মাঠে, কৃষকের বাড়িতে নতুন ধানের ঘ্রাণ ভাসবে। ঢাকঢোল বাজল কি না, তাতে কিছু যায় আসে না। ঘরে ঘরে নবান্নের আয়োজন শুরু হয়ে যাবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কি আর এমনি গেয়ে ওঠেন, ‘উত্তরীয় লুটায় আমার—/ ধানের ক্ষেতে, হিমেল হাওয়ায়।/ আমার চাওয়া জড়িয়ে আছে নীল আকাশের সুনীল চাওয়ায়।/ ভাটির শীর্ণা নদীর কূলে/ আমার রবি-ফসল দুলে,/ নবান্নেরই সুঘ্রাণে মোর চাষির মুখে টপ্পা গাওয়ায়।’

হেমন্তের শস্যভরা মাঠ কমবেশি সবাইকে আনন্দ জোগায়। চাষিরা ধান কাটার প্রস্তুতিতে সচল হয়ে ওঠেন। যাঁরা মাঠ থেকে দূরে, তাঁরাও চোখের আরাম খোঁজেন শস্যের সবুজে, সোনালি ফসলে। কৃষিজীবী এই দেশে যতই নাগরিক গড়ন এদিক-ওদিক বেড়ে উঠুক না কেন, এখানকার কাদামাটি, তার ঘ্রাণ এখনো কমবেশি সবার জীবনের নানা ভাঁজে আর বাঁকে লেগে আছে।

যদিও এই নাগরিক কিংবা গ্রামীণ জীবন নানা সংকটে এখন হাঁসফাঁস করছে। বেশির ভাগ নিত্যপণ্যই দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। এ রকম একটা সময়ে শরতের পূর্ণিমা, হেমন্তের রূপশালি ধানের রূপ আর কতজনই অনুভব করতে পারে! তারপরও মানুষই সব প্রতিকূলতা জয় করে টিকে থাকে। হেমন্ত তাই মানুষের কাছে বন পর্যটন আর সমুদ্রে বেড়ানোর টান তৈরি করে। একটু খোলা হাওয়া, একটু মুক্ত আকাশ আর ঘাসের জমিন খুঁজতে মানুষ পথে বের হয়।

বাংলার বর্ষা ঋতু যদি হয় রবীন্দ্রনাথের, হেমন্ত তবে জীবনানন্দ দাশের। তাই তো তাঁর কাছেই ফেরা যাক, ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে/ অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে;/ মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,/ তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,…’