বাসা যাদের কোটর-খোঁড়লে

গাছের বাসায় টিয়া।
ছবি: এস আই সোহেল

বর্ষাকাল। গ্রামের বাগানের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে ভেড়ারকোট বা বালিহাঁসের সাত থেকে আটটি করে পাখির ছোট ছোট দল। কণ্ঠে ওদের খুশি উপচে পড়ছে যেন! একটানা ডেকেই চলেছে ‘ডিগ্ ডিগ্ ডিগির ডিগ্’। কেননা এই গ্রামের মরা তাল, নারকেল ও খেজুরগাছের মাথার দিকের কোটরে–ফোকরে যে ওদের ডিম অথবা ছানা রয়েছে!

ডিমে তা দেয় হাঁসি। হাঁস তো শুধু আনন্দে উড়ে বেড়ায়। যে বাসায় ছানা ফুটেছে, সে বাসার মা-বাবার দায়িত্ব অনেক—সতর্ক থাকতে হয়, উঁচু বাসা থেকে ছানারা যাতে মাটি বা জলাভূমিতে লাফিয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য কতই না কসরত করতে হয়! এরা ডিম পাড়ে ৬ থেকে ১২টি।

ডিম ফুটে ছানা হতে সময় লাগে ২৩ থেকে ২৪ দিন। এরপর ছানাদের আজব লম্ফ, মাটিতে। উড়ে উড়ে নির্দেশনা দিয়ে জলাভূমিতে নিয়ে যেতে হবে ছানাদের। কত রকম শত্রুই না আছে! আবার কেউ কেউ এখনো জুতসই কোটর-খোঁড়ল খুঁজে বেড়াচ্ছে। ডিম তো পাড়তে হবে!

বাসায় বসন্তবাউরি
ছবি: এস আই সোহেল

এই কোটর-খোঁড়লগুলো প্রাকৃতিক অথবা মিস্ত্রি পাখি কাঠঠোকরাদের অবদান। বৃষ্টির জলে পচে নরম হয়ে যায় মরা গাছ, তৈরি হয়ে যায় খাসা কোটর। যাহোক, সবমিলে বালিহাঁসগুলো মহাব্যস্ত এখন। গ্রামের কমপক্ষে ২৪ থেকে ২৫টি বাসায় ডিম-ছানা রয়েছে এগুলোর। উল্লেখ্য, জায়গার সংকট হলে এক বাসায় দুটি মেয়ে হাঁস ডিম পাড়ে, মিলেমিশে তা দেয়।

লেখার শুরুতে যে বর্ণনা দিয়েছি, সেটা গত শতাব্দীর আশির দশকের; ওই গ্রামেই বসবাস আজও আমার।

অনেক কোটর-খোঁড়ল সারা দিন দখলে রাখে নিশাচর কোটরে–প্যাঁচা, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, বিলাইভুতুম–প্যাঁচারা। ডিম পাড়ার আশায় ওই কোটর-খোঁড়লে যদি ভুলেও উঁকি মারে বালিহাঁসেরা, তাহলে জবর ধমক আর ঠোকর খেতে হয়। দু-তিন প্রজাতির প্যাঁচা ছাড়া সবাই বাসা করে কোটর-খোঁড়লে। আমাদের দেশের শালিকদের ভেতর গাঙশালিক ও গোশালিক ছাড়া অন্যরা কোটর-ফোকরে বাসা করে। সব প্রজাতির কাঠঠোকরা ও বসন্তবাউরিও খোঁড়লবাসী। কোটর-খোঁড়লবাসী পাখিদের ভেতর বসন্তবাউরি ও কাঠঠোকরারা ছাড়া অন্য কেউ নিজেরা কোটর–খোঁড়ল তৈরি করতে পারে না।

এ দুই প্রজাতির পাখির অধিকাংশই জ্যামিতিবিদ, অঙ্কবিদ, বৃক্ষবিদ ও দক্ষ আর্কিটেক্ট। গর্ত খোঁড়ার জায়গাটি নির্বাচন করে খুবই হিসাবকিতাব কষে। উচ্চতা—যাতে মাটি থেকে বাসার নাগাল না পায় শত্রু, বৃষ্টির জল বাসার গর্তে ঢুকলেও জমে না থেকে যাতে চুইয়ে যায় তলদেশে, ডিম-ছানার শত্রুরা যাতে বাসার ভেতরে মাথা সেঁধিয়ে দিতে না পারে বা হাতা বাড়িয়ে ডিম-ছানার নাগাল না পায়। শক্ত চোখা ঠোঁটে ওরা আগে ‘রোডম্যাপ’ এঁকে নেয়। এরপর শুরু করে ঠোঁটের বল্লম চালাতে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট বুনোহাঁস, বালিহাঁসসহ ফোকরবাসী-কোটরবাসী যারা, তাদের কেউই কোটর তৈরি না করতে জানলেও বাসা কিন্তু করে কোটরেই। এর পেছনে প্রকৃতির গোপন রহস্য বা অবদান যেমন আছে, তেমনি আছে কাঠঠোকরা-বসন্তবাউরিদের অবদান। সুবিধাভোগীদের ভেতর আরও আছে ময়না, দোয়েল, নীলকণ্ঠ, ডলার বার্ড, রামগাংরা, বনমালী, হুদহুদ বা হুপো-ধনেশ ইত্যাদি। ধনেশরা কিম্ভূতকিমাকার শক্তপোক্ত গাইতি-ঠোঁট ও কপালের শক্ত বর্ম ব্যবহার করে প্রাকৃতিক কোটর নিজেদের উপযোগী করে নেয়।

এখানে প্রকৃতির একটা রহস্যময় সুন্দর নিয়মের কথা বলি। কোটরবাসী পাখিদের ভেতর সব ধরনের বসন্তবাউরি-কাঠঠোকরা-নীলকণ্ঠ বর্ষার আগেই ডিম-ছানা তোলে। বাসা খালি হয়। তখন অন্য কোটরবাসী পাখিরা এসে বাসা বাঁধে। রাজধানী ঢাকা শহরের দালানকোঠার ফোকর-ফাটলসহ নানান রকম পাইপের ভেতরেও বাসা করে শালিকেরা। রাজধানী শহরে বেশ কিছু প্রজাতির কোটর-ফাটল ও ফোকরবাসী পাখি আছে।

ঢাকা শহরের এমন কোনো মহল্লা নেই, যেখানে এক জোড়া দোয়েল নেই। দোয়েলও কোটরবাসী পাখি। কাঠশালিক-চড়ুইয়ের বাসা দখলের জন্য একটি পুরুষ দোয়েল তিন থেকে চার দিনও মরিয়া চেষ্টা করে। ভবনের ভেন্টিলেটর বা ঘুলঘুলির ভেতরেও বাসা করে কাঠশালিক, ঝুঁটিশালিক ও ভাতশালিকেরা। বক্স, মাটির ঠিলা-বাসা ঝুলিয়ে দিলেও উল্লিখিত পাখিরা বাসা বানায়।

অন্যের বাসা দখলের লড়াই কোটরবাসী কিছু পাখির জন্মগত প্রবল প্রবণতা। যেমন দোয়েল, নীলকণ্ঠ, রামগাংরা, টিয়া, বনমালী, বাদামি প্যাঁচা ইত্যাদি। বালিহাঁসদের তাড়িয়ে-হটিয়ে দিয়ে শিঙ্গেল প্যাঁচাদের আমি বাসা দখলে নিতে দেখেছি। টিয়ারাও ঝাঁকবদ্ধভাবে উপর্যুপরি আক্রমণে শিঙ্গেল প্যাঁচাদের কোটর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। সে সময় বাসায় থাকতে পারে পলাতকের ডিম-ছানা। এ ক্ষেত্রে অপরের বাসা দখলে দলবদ্ধ আক্রমণে টিয়াদেরই আমার কাছে চ্যাম্পিয়ন মনে হয়েছে।

নব্বইয়ের দশকের পর থেকে কমতে কমতে তাল, নারকেল ও খেজুরগাছ এখন নাই-ই হতে চলেছে, মরা গাছের তো প্রশ্নই আসে না। কোটরবাসী পাখিরা তাই আছে বাসা বাঁধার জায়গার সংকটে।

  • শরীফ খান, পাখিবন্য প্রাণিবিষয়ক লেখক