মার্চে ঢাকাবাসী সুবাতাস পাননি এক দিনও 

ঢাবির রসায়ন বিভাগ ও স্টামফোর্ডের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের ভিন্ন পর্যবেক্ষণে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।

ধুলায় দূষিত পরিবেশ। শ্বাস নিতে নাকাল অবস্থা পথচলতি মানুষের। সম্প্রতি মিরপুর বেড়িবাঁধ সড়কেছবি: প্রথম আলো

ঢাকা নগরবাসী গত মার্চে এক দিনও ভালো বায়ু পাননি। ওই মাসে ঢাকার বায়ুর গড় মান স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। আবার বায়ুদূষণের দুটি মানদণ্ডে মার্চে ঢাকার বায়ুর মান আগের বছরের (২০২৩) মানের চেয়ে অনেকটাই খারাপ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রসায়ন বিভাগের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) ভিন্ন পর্যবেক্ষণে বায়ুর এ অবস্থা জানা গেছে।

গত মার্চ মাসেই নগরে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৩ মিলিমিটার বেশি বৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা নগরের দূষণ রোধে বৃষ্টির ওপরই শেষ ভরসা রাখা হয়। কিন্তু এত বৃষ্টিতেও দূষণ কমেনি। আবার এরই মধ্যে চলছে পরিবেশ অধিদপ্তরের ১০০ দিনের বিশেষ কর্মসূচি, যেখানে ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস ইটভাটার দূষণ কমাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা আছে।

বায়ুদূষণ রোধের জন্য এমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়েনি, যাতে ঢাকার বায়ুর মান ভালো হবে।
অধ্যাপক আবদুস সালাম

এবারের মার্চে বেশি দূষণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালামের নেতৃত্বে একদল গবেষক এক যুগের বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দূষণ পরিস্থিতি দেখছেন। দূষণ পরিমাপের একাধিক ধরনের মধ্যে একটি হলো অ্যারোসল অপটিক্যাল ডেপথ (এওডি)। বাতাসের মধ্যে যেসব দূষণীয় উপাদান থাকে, এখানে তা–ই পরিমাপ করা হয়। এর ন্যূনতম সহনীয় মাত্রা হলো দশমিক শূন্য ২। দেখা গেছে, গত বছরের মার্চে এর মাত্রা ছিল দশমিক ৯। আর এ বছর এর মাত্রা হলো ১ দশমিক ৮১ শতাংশ।

বায়ুদূষণে অন্যতম উপাদান পিএম ২.৫ বা ক্ষুদ্রতম বস্তুকণার পরিমাপও করেছেন এই গবেষকেরা। সেখানে দেখা গেছে, গত বছরের মার্চে এর পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৭০ মাইক্রোগ্রাম। এবার তা হয়েছে ৭৮ মাইক্রোগ্রাম, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে পাঁচ গুণের বেশি।

অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, ‘বায়ুদূষণ রোধের জন্য এমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়েনি, যাতে ঢাকার বায়ুর মান ভালো হবে।’

ক্যাপসের পর্যবেক্ষণ

ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া বায়ুমান সূচক বা একিউআইয়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এবারের মার্চ মাসের বায়ুদূষণ আগের আট বছরের (২০১৬-২০২৩) মার্চ মাসের গড় মানের (১৮৮) তুলনায় প্রায় শূন্য দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে গেছে। তবে তা ২০২৩ সালের তুলনায় ৩ শতাংশের বেশি কমে গিয়েছে। যদিও সর্বশেষ মার্চ মাসে একটি দিনও ভালো বায়ুর দেখা পায়নি রাজধানীবাসী।

ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলছিলেন, ‘আমরা দেখেছি মেট্রোরেল যে এলাকাগুলো দিয়ে গেছে, সেখানকার কিছু স্থানে বায়ুর মান ভালো থাকে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ঢাকার বায়ুমানের ভালো লক্ষণ নেই।

আইকিউএয়ারের মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো শহরের নম্বর ৫০ বা তার কম হলে বায়ুর মান ভালো। ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে ‘মাঝারি’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’, ১০১ থেকে ১৫০ নম্বরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’, ১৫১ থেকে ২০০ হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ২০১ থেকে ৩০০ হলে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ুর শহর হিসেবে ধরা হয়। নম্বর ৩০১-এর বেশি হলে বায়ুর মানকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ধরা হয়। মার্চে রাজধানীর বায়ুর মান এক দিনও ৫০–এ নামেনি।

নির্মাণকাজ, ইটভাটাসহ এর সামগ্রীর উৎপাদন ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণে সরকারের সার্বিক অক্ষমতা আছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রায় নেই। এ কারণেই বায়ুদূষণজনিত জনস্বাস্থ্যের বড় ক্ষতির মুখে আমরা
নগরবিদ ইকবাল হাবিব

দূষণের প্রভাব কী

গত মার্চে বায়ুদূষণজনিত রোগী বৃদ্ধির চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর শ্যামলীর ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালে। প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মার্চে প্রতিদিন আউটডোরে ছয় শতাধিক রোগী পেয়েছি শ্বাসকষ্টের নানা সমস্যার। এত রোগী সাধারণত হয় না। আর ইনডোরে তো জায়গায় দেওয়াই যায়নি।’

যে মার্চ মাসের বায়ুর মান নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই মাসেই দেশের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে দুটো গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দুটোর ফলাফলই দেশের দূষণের নাজুক পরিস্থিতি তুলে ধরে। এর মধ্যে ১৯ মার্চ সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৩’-এ বলা হয়, বায়ুদূষণে ২০২৩ সালে দেশ হিসেবে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। আর নগর হিসেবে দ্বিতীয় শীর্ষ নগর ছিল ঢাকা। গত ২৮ মার্চ এক প্রতিবেদন তুলে ধরে বিশ্বব্যাংক বলে, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বায়ুদূষণসহ চার ধরনের পরিবেশদূষণে ২ লাখ ৭২ হাজারের বেশি মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বায়ুদূষণের কারণে।

ঢাবির রসায়ন বিভাগ ও ক্যাপসের প্রতিবেদনের তথ্য সম্পর্কে নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ‘নির্মাণকাজ, ইটভাটাসহ এর সামগ্রীর উৎপাদন ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণে সরকারের সার্বিক অক্ষমতা আছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রায় নেই। এ কারণেই বায়ুদূষণজনিত জনস্বাস্থ্যের বড় ক্ষতির মুখে আমরা।’