বিরল প্রজাপতি গর্দাপেয়ারীর দেখা

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুর বিটে বিরল গর্দাপেয়ারী প্রজাপতিছবি: লেখক

শীত এলেও প্রায় দুই মাস ধরে পাখি-বন্য প্রাণীর সন্ধানে বের হতে পারছিলাম না। কারণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা। অবশেষে সমমনা কয়েকজন মিলে সিলেট বিভাগের পাখি-বন্য প্রাণী পর্যবেক্ষণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

এরই অংশ হিসেবে পাঁচজনের একটি দল ১৪ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আদমপুর বিটে উপস্থিত হলাম। সকালটা ছড়াসহ বনের বিভিন্ন অংশ ঘুরে ঘুরে পাখি-বন্য প্রাণীর সন্ধান করলাম। অল্প কিছু প্রজাতির পাখি-প্রাণীর দেখা পেলেও মনের সাধ পূর্ণ হলো না।

ইতিমধ্যে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে এল। এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে যতটা পারা যায় গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের দিকে খেয়াল করতে করতে চলতে থাকলাম। বনের অর্ধেকের বেশি পথ পাড়ি দেওয়ার পর হঠাৎ সবুজাভ নীলচে-কালো জমিনের ওপর সাদা সাদা ফুটকি ও দাগছোপের একটি পতঙ্গ আমাদের সামনে এসে উড়তে লাগল।

পতঙ্গটির ডানা ও দেহের বর্ণ এবং ওড়ার ভঙ্গিই ওর পরিচয় বলে দিল। কিন্তু দুরন্ত পতঙ্গটি কোনোভাবেই এক সেকেন্ডের বেশি পাতার ওপর বসল না। ফলে অনেক চেষ্টা করেও ওর ছবি তুলতে পারছিলাম না। মিনিট তিনেক অপেক্ষার পর অতি অল্প সময়ের জন্য সে মাটি থেকে মাত্র ফুটখানেক উঁচু বড় পাতার একটি উদ্ভিদের ওপর বসল। জায়গাটি কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাই অতি কষ্টে বিরল পতঙ্গটির কয়েকটি ছবি তুলতে সক্ষম হলাম।

বিরল এই পতঙ্গ এ দেশের অতি সুন্দর এক প্রজাপতি। নাম গর্দাপেয়ারী। নিম্ফালিডি গোত্রের প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Dichorragia nesimachus। প্রজাপতিটির প্রায় ১৭টি উপপ্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশে ওর অবস্থা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য নেই বলে আইইউসিএন বাংলাদেশ এটিকে তথ্য অপ্রতুল শ্রেণিতে রেখেছে। পাহাড়ি অঞ্চলের প্রজাপতিটি দেশের উত্তর-পূর্ব (সিলেট বিভাগ) ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের (চট্টগ্রাম বিভাগ) বাসিন্দা। বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, যেমন ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও জাপানে প্রজাপতিটি বাস করে।

গর্দাপেয়ারী মাঝারি থেকে বড় আকারের প্রজাপতি। প্রসারিত অবস্থায় এক ডানার এক প্রান্ত থেকে অন্য ডানার বিপরীত প্রান্ত পর্যন্ত ৬৫ থেকে ৮৫ মিলিমিটার লম্বা। ডানা ও দেহের ওপরটা মখমলে ধূসরাভ। চোখ নীল ও শুঙ্গ ধূসরাভ। ডানার ওপরের অংশ গাঢ় সবুজাভ-নীল এবং তাতে প্রচুর সাদা ও কিছু কালো ফুটকি থাকে। সামনের ডানার নিচের দিকটা বেগুনি-কালো। আর পেছনের ডানার নিচটা আবছা কালো। ডানার ফুটকি ও দাগছোপগুলো ওপরের অংশের মতোই, তবে আরও বড় ও সুস্পষ্ট। এ ছাড়া পুরুষের ডানায় একটি ও স্ত্রীর ডানায় দুটি আঁকাবাঁকা প্রান্তিক রেখা রয়েছে। তবে উপপ্রজাতি এবং ভৌগোলিক অবস্থানভেদে প্রজাপতিটির দেহ ও ডানার রঙের পার্থক্য হতে দেখা যায়।

এটি একটি আদর্শ পাহাড়ি প্রজাপতি। বনের ঘন অংশে বসবাস করে। সচরাচর আগস্ট থেকে ডিসেম্বরে কম উচ্চতায় ওড়ে। পুরুষগুলোকে পাহাড়ি বনের ছড়া ও জলাধারের পাশে পানির কাছে কাদামাটিতে বসে থাকতে দেখা যায়। এরা কাদামাটির রস ছাড়াও প্রায়ই প্রাণীর মল চুষে তা থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করে।

গর্দাপেয়ারীর শূককীটের পোষক গাছ ও জীবনচক্র সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

  • লেখক: পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ