ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না
রাত আটটা-সাড়ে আটটা হবে—তিনজন বের হলাম হিমঝুরি অভিযানে। হিমঝুরি ফুল ফোটে নভেম্বরে, আমরা বেরিয়েছি অক্টোবরের শেষ দিনে। তাই সন্দেহটা থেকেই গেল, সুগন্ধি এ ফুলের দেখা পাব তো আজ? ফুল ফোটে রাতের বেলায়, দিনে ঝরে যায়। তাই দিনের বেলায় সে ফুল দেখতে যাওয়া বৃথা। রাতই হলো সে ফুল দেখার মোক্ষম সময়।
রাত না হলে হিমঝুরির আসল সৌরভটাও অনুভব করা যায় না। জানামতে, ঢাকা শহরে মাত্র দুটি হিমঝুরিগাছ আছে। একটি ধানমন্ডিতে ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনের গেটে, অন্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোকারম ভবনের গেটে। প্রথম গেলাম ছায়ানটে। রাত হলেও জায়গাটা আলো ঝলমল। সে আলোয় বড় বৃক্ষটার দিকে তাকিয়ে নিরাশ হলাম—কোনো ফুল নেই। নিরাপত্তা প্রহরী জানালেন, আরও সপ্তাহ দুই পর এলে ফুল দেখতে পাবেন। ফুল ঝরে গাছের তলা ভরে যায়।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছটি নিরাশ করেনি। সে গাছটার মগডালে অল্প অল্প ফুল ফুটেছে, তলায় কিছু ফুল ঝরেও পড়ে আছে। কুড়িয়ে তার ঘ্রাণ নিলাম। অভিযান সফল। আমরা আনন্দে এবার ছুটলাম শিশু একাডেমির ভেতরে লাগানো হিমঝুরিগাছটা দেখতে। সেখানে সেটি পেলাম না, কিন্তু এক স্বর্গীয় সৌরভে যেন থমকে দাঁড়ালাম। বাগানের কোনাটায় একটা কামিনী আর একটা শিউলিগাছ। ফুল ফুটে ভরে আছে। গাছের তলায় দাঁড়িয়ে মনে হলো যেন স্বর্গের কোনো বাগানে আছি। আকাশে আধা চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে। কিন্তু ঢাকা শহরে আলোর ঝলকানিতে তার আসল সৌন্দর্য বোঝা দায়। শিউলি আর কামিনীগাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে সে চাঁদকে দেখে মনে ভাসতে লাগল ‘কাজলা দিদি’ কবিতার লাইনগুলো ‘পুকুর ধারে, নেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে,/ ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই;’।
ফুলের এমন সুগন্ধ হয়? চারপাশ সে সুগন্ধে আমোদিত। ইচ্ছে হচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে সারা রাত সেই সৌরভে সিক্ত হয়ে কাটিয়ে দিই। রাত ফুরোলেই সেসব ফুল টুপটাপ করে ঝরে পড়বে, ফুলও এই তীব্র সুগন্ধ হারাবে। সে রাতে বিমোহিত হয়ে আমরা অনেকটা সময় সেখানে কাটিয়ে দিলাম।
ফিরে আসতে মন চাইছিল না, তবু ফিরতে হলো। ফেরার পথে মনে পড়ল ২০১৬ সালের একটি ঘটনা। জাপানের মিয়াজাকি অঞ্চলের একটি ছোট্ট শহর শিনতোমিতে বাস করতেন ৮৬ বছর বয়সী তোশিউকি। তাঁর স্ত্রী ইয়াসুকো ডায়াবেটিসে অন্ধ হয়ে জীবনে বেঁচে থাকার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ঘর থেকে বের হতেন না, কারও সঙ্গে কথাও বলতে চাইতেন না। তাঁর স্বামী তাঁর বাড়ির চারপাশে সুগন্ধি ফুশিয়া ফুল লাগিয়ে ভরে দেন। ফুলগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, সৌরভও তেমনি। গোলাপি রঙের সেসব ফুলের সৌন্দর্য তাঁর স্ত্রী দেখতে পেতেন না ঠিকই, কিন্তু সেই সুগন্ধি ফুলের সৌরভের আকর্ষণে তিনি আবারও জীবনের প্রতি আগ্রহ ফিরে পান। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে আসেন, ঘুরেফিরে বেড়ান বাড়ি ও খামারের আনাচকানাচে। তোশিউকি হয়ে ওঠেন ভালোবাসার অপূর্ব দৃষ্টান্ত। প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিলে সেখানে যান বহু পর্যটক।
আর আমাদের দেশে প্রতি ঋতুতে কত যে সুগন্ধি ফুল ফোটে! পুষ্প পর্যটন তো দূরের কথা, আশপাশে ফোটা সেসব ফুলের সৌরভ নিতেও আমরা সেদিকে পা ফেলি না। সব ঋতুতেই এ দেশে কোনো না কোনো সুগন্ধি ফুল ফোটে, দরকার শুধু তা দেখা ও তার সৌরভ নেওয়া। এ এক আশ্চর্য নেচার থেরাপি, মন ভালো করার প্রাকৃতিক দাওয়াই।
হেমন্তে এ দেশে ফোটে হিমঝুরি, সোনাপাতি, শিউলি, বকুল, ফিডেল উড ট্রি বা সরস্বতী চাঁপা, নাইট কুইন, নাগেশ্বর, দেবকাঞ্চন ইত্যাদি সুগন্ধি ফুল।
শীতে ফোটে গাঁদা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, বিউমন্টিয়া ইত্যাদি।
বসন্তে তো সুগন্ধি ফুলের অভাব নেই। এ সময় ফোটে মাধবীলতা, কনকচাঁপা, লতাজবা, ভাঁট, হাপরমালি, সহস্রবেলি, গ্লিরিসিডিয়া, সুরভি সাদা কাঞ্চন ইত্যাদি। গ্রীষ্মে ফোটে বেলি, জুঁই, স্বর্ণচাঁপা, শ্বেতচাঁপা, জহুরিচাঁপা, উদয়পদ্ম বা ম্যাগনোলিয়া, কুরচি, কেলিকদম, নাগলিঙ্গম, পাদাউক, পারুল, কনকসুধা, রূপেলিয়া, চামেলি, ঝুমকোলতা, ক্যানাংগা বা অপরূপ চাঁপা, কামিনী, গন্ধরাজ, কাঠগোলাপ, দুলিচাঁপা, কাঁঠালিচাঁপা, গুস্তাভিয়া, মালতী, তারাঝরা বা অ্যারোমেটিক জুঁই, পলকজুঁই, পার্সিয়ান জুঁই, বনপারুল, সুরভিরঙ্গন, ফ্রাইড এগ ট্রি ইত্যাদি সুগন্ধি ফুল।
বর্ষায় ফোটে কদম, সুদর্শন বা স্পাইডার লিলি, রজনীগন্ধা, মধুমঞ্জরি, সুরভি মধুমঞ্জরি, হাসনাহেনা ইত্যাদি। শরতে ফোটে ছাতিম, দোলনচাঁপা, ব্রুনফেলসিয়া বা বিচিত্রা, হলুদ ব্রুনফেলসিয়া ইত্যাদি সুগন্ধি ফুল। তা ছাড়া সম্প্রতি নতুন কিছু সুগন্ধি ফুল এ দেশে এসেছে বলে জানান মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের সুলতানপুর গ্রামের উদ্ভিদ সংগ্রাহক তানভীর আহমেদ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শঙ্খপুষ্প, কুসুমচাঁপা, লাল কুরচি, পার্সিয়ান জুঁই, গোলাপি দোলনচাঁপা, হলুদ দোলনচাঁপা, হলুদ হাসনাহেনা, গোলাপি হাসনাহেনা, দিবা হাসনাহেনা, মাউন্টেন অরেঞ্জ, লতা কাঠগোলাপ, ডম্বিয়া, সুইট ওসমানথাস, টারেন্না, লিলিয়াম ইত্যাদি।