পান্থপাদপ, মরুজয়ের সেনা

জামালপুরের লুইস পার্কে পান্থপাদপের বীথিছবি: লেখক

‘ওরা যে এই প্রাণের রণে মরুজয়ের সেনা

ওদের সাথে আমার প্রাণের প্রথম যুগের চেনা’

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গিয়েছিলাম জামালপুর সদর উপজেলার বেলটিয়ায় লুইস ভিলেজ রিসোর্ট অ্যান্ড পার্কে। ওখানে একটি হেঁটে চলার পথের দুপাশে সারি করে লাগানো পান্থপাদপের দেখা পাই। এ ছাড়া ময়মনসিংহের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সামনে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের বাগানে, বৈলরের ড্রিম ভিলেজ পার্কে এই গাছ দেখেছি।

পান্থপাদপ আমাদের দেশি গাছ না হলেও নামটি খুবই পরিচিত। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আলংকারিক উদ্ভিদ হিসেবে বাগানে বা গৃহে চাষাবাদ করা হয়, যা বাগানের শোভাবর্ধন করে। পাতার গোড়ায় এই গাছ পানি সঞ্চয় করে রাখে। এর পাতার গোড়ায় ছিদ্র করলে স্বচ্ছ জলের একটি ধারা নির্গত হয়, এর দ্বারা মরুভূমির পথিক তৃষ্ণা নিবারণ করে।

‘পান্থ’ মানে পথিক আর ‘পাদপ’ শব্দের অর্থ গাছ। অর্থাৎ এদের বাংলা নামের অর্থ পথিকের গাছ। এর পাতা শুধু পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তার করে, তাই একে দেখে দিক নির্ণয় করা যায়। মরুভূমিতে দিগ্‌ভ্রান্ত তৃষ্ণার্ত পথিকের একমাত্র ভরসা এই গাছ। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পান্থপাদপকে মরুজয়ের সেনা বলেছেন। ছোট থাকতে কলাগাছের সঙ্গে এর খুব মিল। কলাগাছের চারদিকে পাতা বের হয়, পান্থপাদপের পাতা ময়ূরপুচ্ছের মতো বৃত্তাকারে সাজানো থাকে। এই বৈশিষ্ট্য দেখে পান্থপাদপ সহজে চেনা যায়। তবে এর কাণ্ড কলার মতো নরম নয়। এর গুঁড়ি বা কাণ্ড দেখতে অনেকটা পাম বা সুপারিগাছের মতো। কাণ্ড দৃঢ়, ধূসর বর্ণের এবং গায়ে পত্রক্ষত থাকে। সম্পূর্ণ গাছটিকে একটি বিশাল হাতপাখা বলে মনে হয়।

পান্থপাদপের বৈজ্ঞানিক নাম Ravenala madagascariensis, গোত্র Strelitziaceae, ইংরেজিতে Traveler’s Palm, Traveler’s Tree নামে পরিচিত। অনেকের কাছে এটি’ বিলেতি কলাগাছ’ নামে পরিচিত। Ravenala গণের একমাত্র প্রজাতি এটি।

বাড়ির উঠানের চারদিকে, রাস্তার দুপাশে সারি করে এবং বাড়ির প্রবেশপথের দুপাশে এই গাছ লাগালে দৃষ্টিনন্দন হয়। পাতার কক্ষ থেকে এর মঞ্জরি হয়, অনেক মঞ্জরিপত্রে আচ্ছন্ন থাকে। এই সবুজ মঞ্জরিপত্র আকৃতিতে অনেকটা নৌকার মতো, সামনের দিকে সরু। শরতে ও হেমন্তকালে ফুল ফোটে। ফুল অত্যন্ত ছোট।

পূর্ণবয়স্ক উদ্ভিদ প্রায় ২০ ফুট উঁচু। কাণ্ড সরল, উন্নত, শাখাহীন, পামগাছের মতো। পাতা বিরাট, দীর্ঘ, কলাপাতার মতো। পাতা পক্ষল, শিরাবিন্যাস সমান্তরাল। এদের পুষ্পমঞ্জরি অক্ষীয় স্পাইক। উঁচানো বড় বড় ডাঁটায় নৌকাকৃতি পত্রপুট থাকে, তাতে হয় ফুল। পুষ্প উভলিঙ্গিক, বৃত্যংশ (বাইরের চক্রের সদস্য) ৩টি, চিকন, সমান, সরু, ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতাগুলো কাণ্ডের মাথায় দুপাশ থেকে সারিবদ্ধভাবে উঁচানো অবস্থায় থাকে। পাতার খাটো এবং প্রশস্ত গোড়া সীথযুক্ত, যা সাধারণত পানি ধারণ করে, পত্রবৃন্ত লম্বা, এমনকি পত্রফলক থেকে অপেক্ষাকৃত লম্বা, মধ্যশিরা সুস্পষ্ট, গৌণ শিরা সমান্তরাল। পুংকেশর ৬টি, ১০-১২ সেন্টিমিটার লম্বা। বীজ অসংখ্য, শক্ত, উজ্জ্বল নীল তন্তু দ্বারা আবৃত থাকে।

আদি নিবাস আফ্রিকার দক্ষিণ–পূর্ব উপকূলীয় দ্বীপ মাদাগাস্কারে। পান্থপাদপ মাদাগাস্কারের প্রকৃত গাছ হলেও ইদানীং উষ্ণমণ্ডলের সর্বত্র পাওয়া যায়। আমাদের দেশে ফল দুষ্প্রাপ্য। মাটির গভীরে লুকানো কন্দ থেকে নতুন চারা জন্মে। গোড়ার চারা ও বীজ থেকে বংশবৃদ্ধি হয়।

মাদাগাস্কার, ভারত ও আফ্রিকার কিছু দেশে এই উদ্ভিদ ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। পান্থপাদপের পাতা, পত্রবৃন্ত ও বাকল মাদাগাস্কার দ্বীপপুঞ্জের পূর্ব তীরে এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে কুঁড়েঘরের ছাদ, দেয়াল ও মেঝে তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। উদ্ভিদের শীর্ষ ভাগের রস দিয়ে চিনি তৈরি করা যেতে পারে। এর ফলের শাঁস খাওয়া যায়। বীজের তেলে ব্যাকটেরিয়ারোধী গুণাগুণ রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রান্নায় ব্যবহৃত হয়।

  • লেখক: অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান প্রকৃতিবিষয়ক লেখক