মহাবিপন্ন হয়ে গেল করাত মাছ
দৈহিক গঠন একেবারেই অদ্ভুত। মাথাটা করাতের মতো আর দাঁতগুলো বের হয়ে থাকে। ওজন প্রায় কয়েক মণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাছটির নাম করাত মাছ। একবারই তাকে স্বচক্ষে দেখেছি কক্সবাজারের ফিশ ল্যান্ডিং জোনে। তা-ও প্রায় এক যুগ আগের কথা। এরপর মাছটিকে অনেক খুঁজেছি।
কিন্তু হদিস পাইনি। মাঝেমধ্যে খবরের কাগজে এই মাছ নিয়ে শিরোনাম হয়। হরেক রকমের মিথও শোনা যায়। সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো এই মাছ খেলে নাকি মানুষের ক্যানসার ভালো হয়। বেশির ভাগ উপকূলের মানুষের বিশ্বাসই তা-ই। ঠিক এ তথ্যের কারণেই মাছটির চাহিদা অনেক।
জালে ধরা পড়লে মাছটির আর রক্ষা থাকে না। মানুষের কাছে সহজেই বিক্রি হয়ে যায়। তবে গবেষকেরা বলছেন, এ ধরনের মিথ একেবারেই সত্য নয়। এই একটি কারণেই মাছটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
গোটা দুনিয়ায় বুনো পরিবেশে থাকা পাঁচ প্রজাতির করাত মাছের সব কটিই এখন মহাবিপন্ন।
সম্প্রতি করাত মাছের ওপর আইইউসিএন বিশ্বব্যাপী তার লাল তালিকার সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, গোটা দুনিয়ায় বুনো পরিবেশে থাকা পাঁচ প্রজাতির করাত মাছের সব কটিই এখন মহাবিপন্ন। এই খবর দেখে সত্যিই মর্মাহত হলাম। একটি মাছ পরিবারের সব কটি প্রজাতিই প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথে। মহাবিপন্ন হয়ে যাওয়ায় আর কত দিন এরা প্রকৃতিতে টিকে থাকতে পারে, খুব সহজেই আঁচ করা যায়।
বাংলাদেশে করাত মাছের তিনটি প্রজাতি দেখা যায়। সব কটিই খুবই বিরল। তবে বড় দাঁতের করাত মাছ প্রজাতিটি এখনো আমাদের উপকূলে পাওয়া যায়। প্রায় সময়ই এর বাচ্চা আটকা পড়ে মাছ ধরার জালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলিফা বিনতে হক করাত মাছের ওপর দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন।
২০১৬-১৭ মৌসুমে তিনি প্রায় ৫০টি ধরা পড়া করাত মাছের তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল বড় দাঁতের করাত মাছ। অন্য আরেকটি প্রজাতিটির নাম সরু দাঁতের করাত মাছ। ২০০৬ সালে সর্বশেষ এই মাছটির সন্ধান মেলে। এরপর আর কখনো তাকে দেখা যায়নি। সর্বশেষ প্রজাতিটির নাম হলো সবুজ করাত মাছ। দেখতে খুবই সুন্দর। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের কুয়াকাটা থেকে এটি প্রথম আবিষ্কার করেন আলিফা বিনতে হক। পরে তা তিনি প্রবন্ধ আকারে প্রকাশও করেন।
করাত মাছ ধরার কোনো জেলে বা জাল নেই। এই মাছটি এমনিতেই জালে আটকা পড়ে। তখন জেলেরা কী করবেন, তা বুঝে উঠতে পারেন না। কখনো কখনো এ মাছের দৈহিক গঠন দেখে জেলেরা হতভম্ব হয়ে যান।
সুন্দরবনের নদীগুলো থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত করাত মাছের ভালো বিচরণস্থল আছে। হাজার বছর ধরে এই করাত মাছ এ অঞ্চলে বিচরণ করছে। বিশেষ করে পশুর নদের উপরিভাগে ২০২১ সালে একটি করাত মাছের বাচ্চা জেলেদের জালে আটকা পড়ে।
করাত মাছ ধরার কোনো জেলে বা জাল নেই। এই মাছটি এমনিতেই জালে আটকা পড়ে। তখন জেলেরা কী করবেন, তা বুঝে উঠতে পারেন না। কখনো কখনো এ মাছের দৈহিক গঠন দেখে জেলেরা হতভম্ব হয়ে যান। করাত মাছ জালে আটকা পড়লে বেশির ভাগ সময় মারা পড়ে।
এর দাঁত এমন যে একবার জালে আটকা পড়লে মাছটি আর বের হয়ে যেতে পারে না। ২০০৪ সালের একটি ঘটনা বলি। দুবলার চরের পাশে একটি করাত মাছ আটকা পড়ে। মাছটি এতই বড় আর ভারী ছিল যে দুটি নৌকা মিলেও মাছটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরে আরেকটি নৌকা এনে মাছটিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে কাছের বাজারে এনে বিক্রি করা হয়।
করাত মাছ অবৈধভাবে বেশ পাচারও হয়। প্রতি কেজি করাত মাছ চার হাজার টাকাতেও বিক্রি হয়। কালেভদ্রে একটি করাত মাছ জালে আটকা পড়লে এর দাম হয় লাখ টাকা পর্যন্ত। এত দামি একটি মাছ আটকা পড়লে জেলেরা তা কখনোই ছাড়তে চান না।
এর দাঁত এমন যে একবার জালে আটকা পড়লে মাছটি আর বের হয়ে যেতে পারে না। ২০০৪ সালের একটি ঘটনা বলি। দুবলার চরের পাশে একটি করাত মাছ আটকা পড়ে।
করাত মাছ নিয়ে জেলেরা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জানাশোনা একেবারেই কম। গবেষণাও হয়নি বললেই চলে। এরই মধ্যে সব কটি মাছ প্রজাতির মহাবিপন্ন হয়ে যাওয়া সত্যিই বড় দুঃসংবাদ। সাগর আর উপকূলের পানির বড় বন্ধু করাত মাছ। অথচ মাছটি আমাদের অঞ্চল থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। সরকারিভাবেও খুব বেশি উদ্যোগ চোখে পড়েনি। করাত মাছের মতো একটি প্রজাতি আগামী প্রজন্ম হয়তো আর দেখতে পাবে না।
সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণী গবেষক