গুণে ভরা ননি ফল
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি গিয়েছিলাম ময়মনসিংহের বৈলরের ড্রিম ভিলেজ পার্কে। প্রকৃতিতে তখন শীতের আমেজ। পার্কে বড় এক মাঠের ধারে পাশাপাশি দুটি কটেজ। কটেজের সামনে খোলা মাঠ। মাঠের ওই পাশে ছোটদের কিছু রাইড চোখে পড়ল। রাইডের পেছনে লেক। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। রাইডের পাশেই দেখা পেলাম ননি ফলগাছের। ছবি তুলে ফেললাম ঝটপট। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে ‘বিদেশি ফলদ উদ্ভিদ উদ্যানে’ প্রথম আমি ননি ফলের গাছ দেখি। এই উদ্ভিদের আদি নিবাস দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া। পরে এটি অস্ট্রেলিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে।
উদ্ভিদ ছোট, চিরসবুজ বৃক্ষ। এই ফল মরিন্ডা, হুরদি, সুরঙ্গী, রং-কাঁঠাল, আচ ফল, দারুহরিদ্রা বা হলুদ কুঁচ ইত্যাদি নামে পরিচিত। এটি একটি গুল্ম বা ছোট গাছ। এই গাছ ৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। বাকল ধূসর বাদামি। পাতা বড়, উপবৃত্তাকার থেকে ডিম্বাকৃতির। ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ১৩ সেন্টিমিটার চওড়া এবং পত্রবিন্যাস বিপরীত। অর্থাৎ পাতাগুলো ডালের ওপর জোড়ায় জোড়ায় সাজানো থাকে। মধ্যশিরার সঙ্গে মিডরিবের সঙ্গে পার্শ্বীয় শিরার সংযোগস্থলে ঘন লোম উপস্থিত থাকে। পুষ্পবিন্যাস অক্ষীয় হেড। হেডে ৯০-১০০টি ফুল থাকতে পারে কিন্তু একবার মাত্র কয়েকটি ফোটে। ফুলগুলো সাদা ও নলাকার, পাঁচটি খণ্ডযুক্ত এবং প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা।
ফল প্রথমে সবুজ থাকে। পরে ফ্যাকাশে হলুদ থেকে সাদা বা ধূসর বর্ণে রূপান্তরিত হয়। ফল পাকলে তা থেকে নীল পনিরের মতো একটি তীব্র গন্ধ নির্গত হয়।
এর বৈজ্ঞানিক নাম Morinda citrifolia। এটি Rubiaceae পরিবারের বৃক্ষ। ইংরেজিতে ইন্ডিয়ান মালবেরি, গ্রেট মরিন্দা, ক্যানারি–উড, ননি, পেইনকিলার ট্রি, চিজ–ফ্রুট, রটেন চিজ ফ্রুট ইত্যাদি নামে পরিচিত। উদ্ভিদের সংস্কৃত নাম অক্ষিফলা, অচ্ছুকা।
পাকা ননি ফলের নরম রসালো শাঁস মিষ্টি লাগলেও তা দুর্গন্ধযুক্ত হওয়ায় কেউ সহজে এই ফল খেতে চান না। এ ফলের আদি নিবাস প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভারতবর্ষ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রধান খাদ্য। কটু গন্ধ ও তিক্ত স্বাদ থাকা সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে এই ফল খাওয়া হয়। আমাদের দেশের উপকূলসংলগ্ন লোনা এলাকায় এবং সুন্দরবনসংলগ্ন জনপদে এ গাছ জন্মে। পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, নাটোর ও পাবনা জেলার বনে আপনা–আপনি এ ফলের গাছ জন্মে। এর চাষের জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়া খুবই অনুকূল।
ফুল উভলিঙ্গ ও সুগন্ধি। ফুল ঝরে যাওয়ার পর ফল বড় হতে থাকে। প্রথমে সবুজ, পরে হলুদ ও শেষে সাদা হয়ে যায়। এর ফল যৌগিক। এ গাছের পাতা খুব তেতো। প্রাচীনকাল থেকে ননি ফলের গাছ কাপড় রং করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই রং ত্বকের রোগ সারাতেও ব্যবহার করা হয়। মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, গারো প্রভৃতি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এ গাছের শিকড় ও কাণ্ডের রস প্রস্রাবের বিভিন্ন সমস্যা সারাতে ব্যবহার করেন। হাড়ের সমস্যা দূর করে ননি ফল।
চিকিৎসকদের মতে, যাঁরা হাড়ের সমস্যায় ভুগে থাকেন, তাঁদের জন্য এ ফল খুবই উপকারী। প্রতিদিন ননি ফলের জুস বা শরবত খেতে পারলে খুব তাড়াতাড়ি ব্যথা থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যায়। তীব্র হাঁটুর যন্ত্রণায় ও আর্থ্রাইটিসের সমস্যায় ভোগা রোগীদের জন্যও ননি ফলের শরবত খুবই উপকারী। শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গেলে হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ননি ফল খেয়ে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
শক্তি বাড়াতে ননি ফলের জুড়ি নেই। অনেক সময় শক্তি কমে যায়, ক্লান্তি লাগে ও অবসাদ লাগে; সে ক্ষেত্রে ননি ফলের শরবত বা জুস কার্যকর। ননি ফলের রসে আছে ভিটামিন এ, সি, ই, বি, বি ২, বি ৬, বি ১২, ক্যালসিয়াম, আয়রন, নিয়াসিন, ফলিক অ্যাসিড, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, জিংক, কপার এবং অন্যান্য মিনারেল; যেমন ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, কার্বোহাইড্রেটস এবং ১৫০টির বেশি পুষ্টিগুণসম্পন্ন।
বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, ক্যানসারের মতো ভয়াবহ সমস্যার ক্ষেত্রেও ওষুধের মতো কাজ করে ননি ফল। বিশেষ করে ব্রেস্ট ক্যানসার নিরাময়ের ক্ষেত্রে এটি খুবই উপকারী। শুধু তা–ই নয়, দেহের ইমিউন সিস্টেমকে উন্নত করতে সাহায্য করে ননি ফল। প্রতিদিন ননি ফলের রস খেতে পারলে বিভিন্ন রোগ থেকে অনায়াসেই দূরে থাকতে পারবেন। কারণ, এতে থাকা ছত্রাকবিরোধী, ব্যাকটেরিয়াবিরোধী ও প্রদাহবিরোধী উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ঋতু পরিবর্তনের সময় সর্দি-কাশির সমস্যায় ননি ফলের শরবত খেলে ধীরে ধীরে এসব সমস্যা অনেকটা কমে যায়। অনেক সময় মাথায় চুলকানি হয় বা বিভিন্ন রকম খোসপাঁচড়া হয়ে থাকে। এসব সমস্যা দূর করার জন্য ননি ফল খুবই উপকারী। ননি ফলে রয়েছে ক্যানসার ধ্বংসকারী উপাদান। ব্রেস্ট ক্যানসারের ক্ষেত্রে এটি খুবই উপকারী।
চয়ন বিকাশ ভদ্র, অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক