কুরমা অভয়াশ্রমের পাহাড়ি মুনিয়া

কুরমা পাখি অভয়াশ্রমের বিষকাটালি ঝোপে একটি পাহাড়ি মুনিয়াছবি: লেখক

অতি বিরল চীনা লালগলা পাখির খোঁজে সকাল ৬টা ৫৫ মিনিট থেকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের কুরমা পাখি অভয়াশ্রমে বসে আছি। অবশেষে ৭টা ৩২ মিনিটে আমার সামনের জলাভূমির পাড়ের ঝোপে বহু প্রতীক্ষিত পাখিটির দেখা মিলল। কিন্তু সূর্যের আলোর ছটা তীব্রভাবে মুখের ওপর পড়ায় ছবি ভালো হলো না। পাখিটিও দ্রুত ঝোপের ভেতর হারিয়ে গেল। এরপর সারাটা সকাল ওর খোঁজে দাঁড়িয়ে-বসে কাটালাম। বঘেরি, লম্বালেজি কসাই, লাল মুনিয়া, পাতা ফুটকি, লালগলা, সবুজ সুইচোরা, নিরল বুনো টুনি, বড় কাবাসি ও মেঠো কাঠঠোকরার ছবি তুললাম। আমার সামনের জলাভূমির পাশে জন্মানো বিষকাটালির ঝোপে কিছুক্ষণ পরপর নামতে লাগল নিরল বুনো টুনি ও বঘেরিগুলো লালচে বিচিগুলো খাওয়ার জন্য। এভাবে প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা চলার পর প্রায় ৪০ মিনিট আর কোনো পাখির দেখা নেই। তাই সঙ্গে আনা ফোল্ডিং চেয়ারে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।

যখন ৯টা ৫২ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড, ঠিক তখন বিষকাটালির ঝোপে সাদা-কালোয় মোড়ানো সুন্দর ছোট্ট একটি পাখির আবির্ভাব ঘটল। পাখিটি যখন বিষকাটালির লাল লাল বিচিতে ঠোঁট চালাল, তখনই দেখলাম সাদা-কালোয় ওর রূপের বাহার! পাখিটি প্রথম ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর সিলেট শহরের টিলাগড় ইকোপার্কের বাইরে দেখেছিলাম। সেখানকার এক জারুলগাছে ওর বাসাও পেয়েছিলাম। এরপর একদিন শ্রীমঙ্গল শহরের কাছে, সীতেশবাবুর চিড়িয়াখানায় যাওয়ার পথে দেখেছি।

যাহোক, দ্রুত পাখিটির বেশ কয়েকটি ছবি তুললাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর একই প্রজাতির এক জোড়া পাখি পাশের নলখাগড়ার ঝোপে এসে বসল। যদিও কুরমা অভয়াশ্রমটি ওদের জাতভাই লাল মুনিয়ার প্রজনন ও তিলা মুনিয়ার বিচরণক্ষেত্র; সাদা-কালো মুনিয়াগুলো এই প্রথম দেখলাম এখানে। ২০২২ সালের ২৫ নভেম্বরের ঘটনা এটি।

এরপর পাখিটি দেখেছি কমলগঞ্জের আদমপুর বনের ভেতরে ও গাজীপুরের শ্রীপুরে একটি কৃষি খামারে। গত বছর সেপ্টেম্বরে পাখিটির সঙ্গে আবারও দেখা হলো খাগড়াছড়ি শহরের কাছে পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে।

এতক্ষণ সাদা-কালোয় যে পাখির গল্প বললাম, সেটি এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক গায়ক পাখি পাহাড়ি বা সাদা-কোমর মুনিয়া (হোয়াইট-রাম্পড/হোয়াইট-ব্যাকড মুনিয়া)। গোত্র স্ট্রিলডিডি, বৈজ্ঞানিক নাম Lonchura striata। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিপ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।

এরা লম্বায় মাত্র ১০ সেন্টিমিটার। ওজন মাত্র ১২ গ্রাম। পালকের রঙে গাঢ় কালচে বাদামি ও সাদার প্রাধান্য। হঠাৎ দেখলে সাদা-কালোই মনে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পুরো দেহ গাঢ় কালচে বাদামি। পিঠ, লেজের ওপরের পালক ও ডানার পালকে সূক্ষ্ম হালকা দাগ। কোমর সাদা। ছোট চোখা লেজটি কালো। গলা ও বুক কালচে বাদামি, বুকে সূক্ষ্ম হালকা দাগ। পেট ক্রিম-সাদা। পায়ু কালচে ও তাতে সূক্ষ্ম হালকা দাগ। ওপরের ঠোঁট কালো ও নিচেরটা নীলচে ধূসর। চোখ লালচে বাদামি। পা গাঢ় ধূসর। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির কোমর ও দেহের নিচটা হালকা ছোপযুক্ত বাদামি।

পাহাড়ি মুনিয়া মূলত সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। তবে ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের বন-বাগানেও মাঝেমধ্যে দেখা যায়। এরা জঙ্গল, বনের সাফ করা অংশ, বাগান ও ঝোপে বাস করে। সচরাচর দলে থাকে। মাটিতে খুঁটে খুঁটে ঘাস ও অন্যান্য আগাছার বিচি খায়। ‘ট্রি-ট্রি-ট্রি-প্রিট ও ব্রিট’ স্বরে ডাকে।

মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রজননকাল। এ সময় ছোট গাছের উঁচু শাখায় ঘাস বা বাঁশপাতা দিয়ে ছোট্ট গোলগাল বাসা বানায়। ঘাসফুল দিয়ে পথের ভেতরটা মুড়ে নেয়। বাসার ভেতরেও থাকে ঘাসফুলের গদি। স্ত্রী ৩ থেকে ৮টি ধবধবে সাদা ডিম পাড়ে, যা ১৩ থেকে ১৪ দিনে ফোটে। মা-বাবা ছানাদের পোকামাকড় খাইয়ে বড় করে তোলে।

যদিও বিভিন্ন প্রজাতির মুনিয়া খাঁচাবন্দী অবস্থায় রাস্তাঘাট ও পেট শপে দেদার বিক্রি হচ্ছে; কিন্তু আজ পর্যন্ত পাহাড়ি মুনিয়া কোথাও বিক্রি হতে দেখিনি। যাহোক, কামনা করি, পাহাড়ি সাদা-কালো মুনিয়াগুলো এভাবেই বেঁচে থাকুক অনন্তকাল।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিত্সাবিশেষজ্ঞ