বিপন্ন ট্রি ফার্নের কথা
প্রায় ১৮ বছর আগে মৌলভীবাজার জেলার শাহবাজপুরে একটি বুনো টিলায় প্রথম ট্রি ফার্ন বা গাছ ঢেঁকিয়া দেখি। এর আগে ট্রি ফার্ন নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না। এরপর অবশ্য পাথারিয়া পাহাড় ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে দেখেছি। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত চুনতি অভয়ারণ্যে এই গাছ থাকার রেকর্ড থাকলেও চোখে পড়েনি। বৃহত্তর সিলেটের বনাঞ্চলে ঘুরে নানা রকম ফার্ন দেখে ট্রি ফার্ন যে একটি বিশেষ উদ্ভিদ তা মনেই হয়নি কখনো। প্ল্যান্ট রেড লিস্ট অব বাংলাদেশ গ্রন্থের তথ্যমতে, দেশের ৬ জেলার ১২টি স্থানে এই উদ্ভিদ পাওয়া যায়। স্থানগুলো বান্দরবান, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মৌলভীবাজার ও রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত।
কিন্তু উদ্ভিদটির বর্তমান অবস্থা, বিবেচ্য সংখ্যা, সংকট ও বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে এই উদ্ভিদকে বিপন্ন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নিশ্চিত করে বলা যায়, নিজস্ব আবাসে ট্রি ফার্ন বা গাছ ঢেঁকিয়ার অবস্থা মোটেও সন্তোষজনক নয়।
সাইকাস পেকটিনাটা নামে একই পরিবারের আরেকটি বিপন্ন উদ্ভিদ আছে আমাদের দেশে। সাইকাস–জাতীয় অন্য গাছগুলোর সঙ্গে এ গাছের প্রধান পার্থক্য হলো, এদের পাতা ধারালো বা কণ্টকিত নয়। আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন অনেক আগেই গাছটিকেও বিপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। দেশে গাছটির প্রাকৃতিক আবাস; চট্টগ্রামের বারৈয়াঢালা পাহাড় এবং উত্তর ময়মনসিংহের শালবনে অল্পবিস্তর দেখা যায়। মূলত গাছটির আবাসস্থল ধ্বংস হওয়াই বিপন্নতার প্রধান কারণ।
আমাদের দেশে নানা ধরনের ফার্নের বিচিত্র রকমফের লক্ষ করা যায়। এসব ফার্ন দেখতে বেশ আকর্ষণীয় হওয়ায় আলংকারিক উদ্ভিদ হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। ফার্নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো Ñএ গাছ কম পরিচর্যায় ছায়াযুক্ত স্থানেও চমৎকারভাবে বেঁচে থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে ট্রি ফার্ন আরও বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত ও আকর্ষণীয়। কাণ্ড ও পাতার বিন্যাস শৈল্পিক হওয়ায় এদের উপস্থিতি বনের নান্দনিকতা বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।
ট্রি ফার্ন (Gymnosphaera gigantea) কম উচ্চতার খেজুরগাছের মতো ও গাঢ় বাদামি রঙের গুঁড়িযুক্ত বৃক্ষ। কাণ্ড খাড়া, ৫ মিটার বা তারও বেশি লম্বা হতে পারে। পাতা সাধারণত ২ থেকে ৩ মিটার লম্বা। পাতা দ্বিপক্ষল, পত্রকঅক্ষ গাঢ় বেগুনি রঙের এবং গোড়ায় ঝালরের মতো আবরণযুক্ত, এই ঝালরের রং গাঢ় বাদামি, করাতের মতো দাঁতানো ও রেখাকার। পক্ষক ওপরের দিকে ক্রমাগত সরু এবং প্রান্ত পক্ষের মতো অতিখণ্ডিত। সোরাস বা ধানিপুঞ্জ গোলাকার, দুই সারিতে পক্ষক এর যেকোনো এক পাশে সজ্জিত। প্রতিটি ধানিপুঞ্জে অনেক রেণুস্থলী আছে। একটি পূর্ণতাপ্রাপ্ত রেণুস্থলী বৃত্তযুক্ত, অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের, প্রায় গোলাকার এবং ১১ থেকে ১৬ কোষযুক্ত।
ট্রি ফার্ন ৬০০ থেকে ১০০০ মিটার উচ্চতায় আর্দ্রতাসম্পন্ন খোলা জায়গায় জন্মে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে ছায়াযুক্ত পরিবেশ এবং পাহাড়ি নদীর পাড় এদের প্রিয় আবাস। পূর্ব হিমালয়, ভুটান, দক্ষিণ ভারত, লাওস, মালয় উপদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, দক্ষিণ চীন, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামে এই গাছ দেখা যায়।
এ গাছের শুকনো পাতা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার্য।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক