অনুসন্ধান: ‘চকরিয়া সুন্দরবন’
যে বনে একটি মাত্র গাছ
ধ্বংস হয়ে গেছে দ্বিতীয় বৃহত্তম সুন্দরবন। টিকে আছে একটিমাত্র শ্বাসমূলীয় গাছ। বিপন্ন উপকূল।
আমরা এমন একটি বনের গল্প বলতে যাচ্ছি, যেখানে এখন মাত্র একটি শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) গাছ অবশিষ্ট আছে। অনেকে হয়তো ভাববেন, এক গাছে কি বন হয়? নিশ্চয়ই হয় না। একসময় এই বনেই হাজারো প্রজাতির গাছ, লতাগুল্ম ও পশুপাখির সমাহার ছিল। এর আয়তন ছিল ৩০ বর্গকিলোমিটারের বেশি। সাগর-সংলগ্ন হওয়ায় জোয়ার-ভাটার পানিতে বনের নিম্নাঞ্চল ভেসে যেত, যেখানে সাগরের নানা জাতের মাছ পাওয়া যেত। বন ও স্থানীয় মানুষের মধ্যে ছিল নিবিড় সম্পর্ক।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে ফাঁসিয়াখালীর নতুন মসজিদ এলাকায় দুটি সুন্দরী গাছ দেখা যায়। এটি আসলে একটি। কারণ, গাছ দুটির শিকড় একটি। এখান থেকে ২০ ফুট দূরত্বে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। আশপাশে তেমন জনবসতি নেই।
সম্প্রতি এক দুপুরে গাছটির কাছে গিয়ে দেখা যায়, এর ডালে পাখির কোলাহল নেই। শুধু দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছ, যা হারিয়ে যাওয়া বনের সাক্ষ্য বহন করে। এখানেই দেখা হলো স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল লতিফের সঙ্গে। চকরিয়াকে তিনি সুন্দরবন নামেই চিনতেন। কীভাবে বনটি ‘নাই’ হয়ে গেল, তা নিজের চোখে দেখেছেন। লতিফ থাকেন চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ছগিরশাহকাটা এলাকায়, আদিনিবাস বদরখালীতে।
আবদুল লতিফ বলেন, ‘আঁরা ছোডো হালে সুন্দরবনত যাই মাছ ধজ্জি। এড়ে গোলপাতা আইনত্তু যাইতাম। সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া, ধুন্দল, গোলপাতা গাছ আছিল। ইন ছাড়াও বাঘ, হরিণ, বানর, হনুমান, বনবিড়াল, কুমির, সাপ—হত কিছু দেইতাম। এহন বেয়াগ্গিন শেষ অইগেঐ। মাছর ঘোনা আর নুনর মাঠ ছাড়া কিছু নাই। এহন উদু উগ্গো সুন্দরীগাছ আছে। ইবে চাইবার লাই হত মানুষ আইয়্যে।’ (আমরা ছোটকালে সুন্দরবনে গিয়ে মাছ ধরতাম। সেখানে গোলপাতা আনতে যেতাম। সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া, ধুন্দল, গোলপাতা গাছ ছিল। এ ছাড়া বাঘ, হরিণ, বানর, হনুমান, বনবিড়াল, কুমির, সাপ—কত কিছু দেখতাম। এখন সব শেষ হয়ে গেছে। মাছের ঘের আর লবণ মাঠ ছাড়া কিছু নেই। এখন শুধু একটা সুন্দরীগাছ আছে। এটা দেখতে কত মানুষ আসে।)
এভাবে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে কেবল একটি বনই উধাও হয়নি; এতে স্থানীয় মানুষের জ্বালানির উৎস বিপন্ন হয়েছে, প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ নিঃশেষ হয়েছে, বননির্ভর মানুষ পেশা হারিয়েছে, জলাভূমি নষ্ট হয়েছে, মাটির লবণাক্ততা বেড়েছে, জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস রোধের প্রাকৃতিক বর্ম ধ্বংস হয়েছে। এর আর্থিক ক্ষতিও বিশাল।
অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহুজাতিক সংস্থার প্রশ্রয়ে রাষ্ট্রীয় কথিত উন্নয়ন প্রকল্প কীভাবে একটি প্রাকৃতিক মহাসম্ভার ধ্বংস করে, তা দেখা যায় চকরিয়ায়। এর সঙ্গে মিশে আছে ভুল উন্নয়ন দর্শন, ঋণদাতা গোষ্ঠীর ভ্রান্ত পরিকল্পনা আর রাষ্ট্রের সুবিধাবাদী শ্রেণির লোভ। চকরিয়ার বন ধ্বংসের ফল আমরা পাচ্ছি। আরও দীর্ঘ সময় ধরেই এর প্রভাব থাকবে।’
চকরিয়া সুন্দরবনের অবস্থান
উপমহাদেশের প্রাচীন ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনের একটি ছিল চকরিয়া সুন্দরবন। বাংলাদেশে তিন ধরনের সুন্দরবন রয়েছে: বিশ্বের বৃহত্তম খুলনা অঞ্চলের সুন্দরবন, দ্বিতীয় বৃহত্তম চকরিয়ার সুন্দরবন (যা এখন বিলুপ্ত) এবং তৃতীয়টি হলো বরিশাল ও ভোলা অঞ্চলের সৃজিত সুন্দরবন। চকরিয়া সুন্দরবন চারদিক জলরাশি পরিবেষ্টিত ছিল।
এক সময়ের ঘন সুন্দরবন চকরিয়ার চতুর্দিক ছিল মোটামুটি এমন: পূর্বদিকে আরাকান সড়ক, উত্তর-পূর্ব দিকে জনবসতি, কৃষিভূমি, লবণ মাঠ, সোজা দক্ষিণ দিকে মহেশখালী চ্যানেল। মাতামুহুরী নদীর পশ্চিম পাশের সুন্দরবন রামপুর এলাকা নামে পরিচিত ছিল এবং পূর্ব পাশে ছিল চরণ-দ্বীপ।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার শহরে যাওয়ার পথে চকরিয়া উপজেলা শহর। চকরিয়ার দুই পাশে অসংখ্য দোকানপাট। রাস্তার ডান পাশ দিয়ে বদরখালী সড়ক। এ সড়ক ধরে বদরখালী যাওয়ার সময় দুই পাশে যত দূর পশ্চিমে যাওয়া যায়, শুধু লবণের ঘের।
চকরিয়া সদর ছেড়ে পশ্চিম বড়ভেওলা ইউনিয়নের বহদ্দারকাটা এলাকায় রাস্তার পাশেই দেখা হলো একদল শ্রমিকের সঙ্গে। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে লবণের ঘের। ঘের থেকে লবণ এনে সড়কের পাশেই স্তূপ করে রাখছেন শ্রমিকেরা। এসব শ্রমিকের একজন জহুরুল ইসলাম (৪২) জানান, তিনি ছোটবেলায় বনের কিছু অংশ দেখেছেন, এখন সেসব স্মৃতি।
১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘কক্সবাজার ওয়ার্কিং প্ল্যান ফর দ্য পিরিয়ড ফ্রম ১৯৫০ টু ১৯৬৯-৭০’ শীর্ষক এক সরকারি নথিতে বলা হয়েছে, চকরিয়া সুন্দরবন ১৯০৩ সালে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ম্যানগ্রোভ বন। কৃষিজমি সম্প্রসারণ, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ, মাছ ধরা ইত্যাদির জন্য বনটি নানাভাবে মানব হস্তক্ষেপের শিকার হয়। চকরিয়া সুন্দরবন প্রায় ২১ হাজার ১০২ একর এলাকাজুড়ে ছিল পঞ্চাশের দশকে। পরবর্তী সময়ে ১৮ হাজার ৫০৮ একর জমিকে সংরক্ষিত বন এবং বাকি অংশকে রক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ আল-আমিন বলেন, ‘বন উজাড় করে চিংড়ির ঘের, তারপর সেই চিংড়ি চাষে ধস, অতঃপর লবণের ঘের—এই হলো চকরিয়া সুন্দরবনের ইতিহাস। এখন সাবেক বনভূমি লবণের চাষ করতে করতে যে অবস্থায় গেছে, তাতে মাটি তার প্রায় সমস্ত সক্ষমতা হারিয়েছে। বন পুরো উজাড় হওয়ার শুরুটা গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে।
যেভাবে বন বিনাশ হলো
চকরিয়ার বনে মানুষের বসতি স্থাপন অনেক আগে থেকেই হয়েছিল। বন কেটে স্থানীয় মানুষের একটি অংশের জন্য সেখানে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়। তার পরও সত্তর দশকের শুরুতে চকরিয়ায় চমৎকার বন ছিল।
বসতি স্থাপনকারীরা সমুদ্রের পানি থেকে লবণ উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। লবণ প্রক্রিয়াজাত করার জন্য তাঁরা বনের কাঠের ওপর নির্ভর করতেন। এই কার্যকলাপ বন ধ্বংসে এক ধরনের ভূমিকা রেখেছিল; কিন্তু তা ভয়ংকর ছিল না।
‘ডিমাইজ অব চকরিয়া সুন্দরবন: হু ইজ টু ব্লেম’ নামের একটি গবেষণায় বন বিনাশের চিত্র তুলে ধরেছেন লস্কর মুকসেদুর রহমান ও নিখিল চাকমা। তাঁরা বন ধ্বংসের শুরুর কথা লিখেছেন, ১৯৭৭ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় একটি সরকারি আদেশের মাধ্যমে চকরিয়া সুন্দরবনের রামপুর ব্লকের বদরখালী ঘোনা মৌজায় ৫৬৩ একর সংরক্ষিত বন এক বছরের জন্য ইজারা দেয় ‘শ্রিম্প অ্যান্ড ডাকারি ফার্ম’কে। এই খামার ছিল স্থানীয় প্রভাবশালী গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর মালিকানাধীন। ইজারার উদ্দেশ্য ছিল চিংড়ি চাষ, হাঁস পালন ও অ্যাগ্রোফিশারি কার্যক্রম। এটিই ছিল চকরিয়া সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনভূমি চিংড়ি চাষের জন্য সরকারের প্রথম ইজারা উদ্যোগ, যা পরে এই বনাঞ্চল ধ্বংসের পথ খুলে দেয়।
চকরিয়া সুন্দরবনের বড় ধ্বংস শুরু হয় যখন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্বব্যাংক ওই এলাকায় চিংড়ি চাষে বিনিয়োগ শুরু করে।
ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, এডিবি ১৯৮২ সালে চিংড়ি চাষে অর্থায়ন শুরু করে। এর আওতায় শতাধিক চিংড়ি খামার (প্রতিটি ১১ একর করে) চালু এবং একটি ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এডিবির অ্যাকুয়া কালচার প্রকল্পের নামে চিংড়ি চাষের প্রকল্প শুরু হয়। দ্বিতীয়বারের মতো কৃষি মন্ত্রণালয় সংরক্ষিত বনভূমির আরও ২ হাজার একর জমি মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তরের জন্য আদেশ দেয়। চকরিয়ায় গাছ কাটার ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় আশির দশকেই।
‘চকরিয়া সুন্দরবন: যে বনে গাছ নেই’ নামে একটি অসাধারণ প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন পরিবেশবাদী ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) পরিচালক ফিলিপ গাইন। তিনি প্রথম এই বন বিনাশের চিত্র বড় পরিসরে জনসমক্ষে আনেন।
তাঁর লেখা ‘স্টোলেন ফরেস্ট’ নামের বইতে বলা হয়েছে: বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ সরকারকে রপ্তানিমুখী উদ্যোগে সহায়তা করতে ঋণ দিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) সেখানে মাছ চাষের প্রকল্প নিয়ে আসে ১৯৮৬ সালে। সে সময় চিংড়ি চাষের জন্য ২৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে তাদের প্রকল্পের মাধ্যমে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বনের এলাকায় ৫০০ চিংড়িঘের হয়। প্রতিটির আয়তন ছিল ১০ একর।
এসব প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে সমৃদ্ধ বনটি ধীরে ধীরে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। এই বন বিনাশ চোখের সামনেই দেখেছেন চকরিয়ার বাসিন্দা সাদেকুল ইসলাম (৭৫)। তিনি বলেন, বন ধ্বংসে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। চোখের সামনে সুন্দরবনের কেওড়া, বাইন ও সুন্দরীগাছ কেটে মাছের ঘের করা হয়েছে।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) কাছ থেকে চকরিয়া সুন্দরবনের উপগ্রহ চিত্র সংগ্রহ করা হয়। সেখানে বন ধ্বংসের সঙ্গে বন এলাকায় চিংড়িঘের তৈরির সরাসরি সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চকরিয়ার বন ১৯৭৯ সাল পর্যন্তও অটুট ছিল। ওই সময় বনের আকার ছিল ১৫ হাজার একরের বেশি। ১৯৯৫ সালে প্রায় পুরো বন উধাও হয়ে গিয়ে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬৬ একরে।
বন কেটে চিংড়িঘেরের যাঁরা মালিক হন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী এবং ঢাকাবাসী সরকারি-বেসরকারি ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা।
বন বিভাগের কাছ থেকে ১০ একরের ৩০টি প্লট পেয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংক। তাদের মৎস্য চাষ প্রকল্প এখনো আছে। চকরিয়ার রামপুর মৌজায় ইছারখালী ফাঁড়ি-সংলগ্ন এলাকায় এখনো আছে গ্রামীণ মৎস্য ও পশুসম্পদ ফাউন্ডেশন।
অর্থদাতাদের সাফাই
চকরিয়া সুন্দরবন ধ্বংসে এডিবি এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এত বড় ধ্বংসের পরও এই দুই প্রতিষ্ঠান এর দায় নেয়নি; বরং ১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের প্রকল্প সমাপনী প্রতিবেদনে বলেছে, প্রকল্পের ফলে কোনো পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দেয়নি; বরং দীর্ঘ মেয়াদে জলাবদ্ধতার মতো সমস্যা মিটেছে। কোনো সুন্দরবন কাটা হয়নি।
তবে ১৯৮৯ সালে এডিবির প্রতিবেদনে ১ হাজার ৯৭৬ একর বন উজাড় হওয়ার কথা স্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই বন পরিষ্কার করার ফলে স্পষ্টভাবে চিংড়ি ও মাছের প্রজনন এবং নার্সারির ক্ষেত্র হ্রাস পেয়েছে, বিশেষ করে প্রকল্প এলাকায় চকরিয়া সুন্দরবনের প্রায় ১ হাজার ৯৭৬ একর ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধ্বংস হয়েছে।
বাংলাদেশের বন ও পরিবেশের নানা ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন এবং এর বিরূপ প্রভাব নিয়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন ফিলিপ গাইন। তিনি বলেন, চকরিয়ায় বন বিনাশ স্থানীয় প্রভাবশালীরাই শুরু করেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে ব্যাপক হারে চিংড়ি চাষে এ বন একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু এত বড় এক প্রাকৃতিক সম্পদের আধার ধ্বংস হলেও এসব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রকৃতিবিনাশী অর্থায়ন বন্ধ করেনি।
প্রাকৃতিক বর্ম ধ্বংস
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই ঘূর্ণিঝড়প্রবণ। আর সেখানে ঢাল বা বর্ম হিসেবে কাজ করে সুন্দরবন। সিডর বা আইলার মতো বড় মাপের ঘূর্ণিঝড় খুলনা অঞ্চলে আঘাত করলেও কেবল সুন্দরবনের কারণেই ক্ষতি অপেক্ষাকৃত কম হয়েছে বলে দুর্যোগ বিশেষজ্ঞদের অভিমত। চকরিয়া সুন্দরবনের অবস্থানকে একটি ফানেল বা চোঙা বা নলের সঙ্গে তুলনা করেন গবেষকেরা। এখানে ঘূর্ণনবায়ু এসে আঘাত করত। আর বন যখন ছিল, তখন এটি সুরক্ষা দিত। কিন্তু ১৯৯১ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় যখন কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে এসে উপস্থিত হলো, তখন চকরিয়া ছিল বিরানভূমি। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে এক রাতেই লক্ষাধিক মানুষ নিহত হন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ আল-আমিন দীর্ঘদিন ধরে উপকূলীয় বন নিয়ে গবেষণা করেন। চকরিয়া সুন্দরবনের বিনাশ তাঁর কাছে এক বড় পরিবেশগত বিপর্যয়। তিনি বলেন, এ বন ছিল অসংখ্য প্রজাতির গাছ ও প্রাণীর আবাসস্থল। এর বাইরে এ বনের বড় গুরুত্ব ছিল, এটি প্রাকৃতিক ঝড়ঝঞ্ঝায় বর্ম হিসেবে কাজ করত। ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজার উপকূলে যে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ ও সম্পদহানি হয়েছে, তা হয়তো রোধ করা যেত, যদি এই বন থাকত।
চকরিয়ার বাসিন্দা এবং বেসরকারি এক সংগঠনের কর্মী জয়নাল হোসেন বলেন, ‘এখনো বড় আকারের ঘূর্ণিঝড় আঘাত করলে অজস্র মানুষের প্রাণ যাবে। চকরিয়ার মতো বন আমাদের রক্ষাকবচ ছিল। কিন্তু তা আর ফিরে আসবে না। বন উজাড় করে পুরো কক্সবাজার উপকূলকে মৃত্যুর মুখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
বনের ক্ষতি, কার ক্ষতি
বন কেটে উজাড় করার পর প্রথম পাঁচ বছর চিংড়ির উৎপাদন অপেক্ষাকৃত ভালো হয়েছিল। তার পর থেকেই এখানে কমতে থাকে চিংড়ির উৎপাদন। গবেষণার ওপর ভিত্তি করে অধ্যাপক মোহাম্মদ আল-আমিন বলেন, ‘এর কারণ হলো বন কাটায় যেসব অণুজীব নষ্ট হয়ে গেছে, তা আর ফিরে আসেনি। দিন দিন সেগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। মাটির গুণগত মান নষ্ট হয়েছে। এর মাশুল আমাদের দিতে হবে।’
জার্মানির ব্রান্ডেনবার্গ ইউনিভার্সিটির গবেষক শাফি নূর ইসলাম ‘অ্যান অ্যানালাইসিস অব দ্য ড্যামেজেস অব চকরিয়া সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ ওয়েটল্যান্ডস অ্যান্ড কনসিকোয়েন্সেস অন দ্য লাইভলিহুডস ইন সাউথইস্ট কোস্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় এ বনের ক্ষতির নানা দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন, ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম মানবকল্যাণে দুটি প্রধান উপায়ে অবদান রাখে। প্রথমত, ইকোসিস্টেমের গঠনমূলক উপাদান যেমন উদ্ভিদ, প্রাণী, মাটি, ভূমি ও পানি, যা সব ধরনের অর্থনৈতিক উৎপাদনের কাঁচামাল সরবরাহ করে। দ্বিতীয়ত, ইকোসিস্টেম জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তামূলক কার্যাবলি এবং অন্যান্য মূল্যবান সেবা প্রদান করে, যেগুলোর অনেকগুলোই মানবজীবনের সহায়তা ও কল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণায় বন ধ্বংসের ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরে বলা হয়, চকরিয়া সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় অন্তত চার লাখ মানুষ তাঁদের জীবিকা হারান। বন থাকার সময় অন্তত ২০ প্রজাতির মাছ ছিল। এখন এর প্রায় কোনোটিই নেই। চকরিয়া এলাকার মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ৭ দশমিক ৫ ডিএস/এম বা এর বেশি। এই অতিরিক্ত লবণাক্ততা চকরিয়া সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলে ধান ও শাকসবজির চাষের জন্য ক্ষতিকর।
চকরিয়া সুন্দরবনের প্রাণসম্পদ নষ্ট হওয়ায় কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে বড় কোনো গবেষণা নেই। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোর সোশ্যাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটির সহযোগী অধ্যাপক মো. সারোয়ার হোসেন এ নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। গবেষণা অনুযায়ী, ম্যানগ্রোভ বন সবচেয়ে বেশি প্রতিবেশ পরিষেবা (যেমন খাবার, মাছ, কাঠ, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ) প্রদানের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন, ‘১৯ হাজার ৭৭৮ একরের বেশি ম্যানগ্রোভ হারিয়ে গেছে চকরিয়া থেকে। সামগ্রিক ভিত্তিতে, চিংড়ি চাষ ও অন্যান্য মানবসৃষ্ট কারণে এই ম্যানগ্রোভ হারিয়ে যাওয়ার ফলে ন্যূনতম ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার সমমানের প্রতিবেশ পরিষেবা থেকে প্রতি বছরে বঞ্চিত হয়েছি আমরা।’
জলবায়ু পরিবর্তন ও চকরিয়া বন ধ্বংস
সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বা সুন্দরবন প্রতি হেক্টরে ন্যূনতম ১৫০ মেগা টন কার্বন সংরক্ষণ করে। ম্যানগ্রোভ বন একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্বন সিঙ্ক এবং সবচেয়ে কার্যকর উপকূলীয় কার্বন বাস্তুতন্ত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়।
গবেষক সারোয়ার হোসেন বলেন, এই ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের কারণে জলবায়ু অভিযোজন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। চকরিয়া সুন্দরবন ধ্বংস জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। চিংড়ি চাষ একটি সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে, তারপর চিংড়ির উৎপাদন দ্রুত কমতে থাকে। তাই ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস করে চিংড়ির উৎপাদন, চিংড়ির ভবিষ্যৎ উৎপাদন, বাণিজ্য ও ম্যানগ্রোভ বনের প্রয়োজনীয়তার দিক থেকে কোনোভাবেই টেকসই উন্নয়ন নয়।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) চকরিয়া এলাকার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে। ফ্রন্টিয়ার্স ইন পাবলিক হেলথ নামের এক সাময়িকীতে উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে গর্ভপাতের ঝুঁকি নিয়ে আইসিডিডিআরবির একটি গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। ‘দ্য রিস্ক অব মিসক্যারেজ অ্যাসোসিয়েটেড উইথ অ্যামবিয়েন্ট টেম্পারেচার: এভিডেন্স ফ্রম কোস্টাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি হয় চকরিয়া এলাকায়। দেখা গেছে, যেসব নারী ২৮°ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ৩২°ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার মধ্যে অবস্থান করেছেন, তাঁদের গর্ভপাতের ঝুঁকি ২৫ শতাংশ বেশি ছিল। গবেষণায় দেখা যায়, চকরিয়ায় অতিরিক্ত তাপমাত্রার জায়গায় গর্ভপাত, ডায়রিয়া, লোকাল সাইট ইনফেকশন, গলাব্যথা—এই রোগগুলো বেশি হয়।
আইসিডিডিআরবির চিকিৎসক ও গবেষক সালেহ মোহাম্মদ ইকরাম বলেন, ‘আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, চকরিয়া এলাকায় শিশুদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা, কিডনির রোগের মৃত্যুহার, ছত্রাকজনিত সংক্রমণ অপেক্ষাকৃত বেশি। এর সঙ্গে উচ্চ তাপমাত্রার একটা সম্পর্ক থাকতে পারে।’
আশা তবু রয়ে যায়
চকরিয়ার বন ধ্বংস আসলে স্থানীয় কোনো মানুষের উন্নয়ন বয়ে আনেনি, তা মানেন মহেশখালী চ্যানেল-সংলগ্ন মগনামা খালের মো. হাফিজুর রহমান। মহেশখালী চ্যানেল পর্যন্ত ছিল ঘন বন। আর তা হাফিজুর দেখেছেনও। এ জায়গা পড়েছে চকরিয়ার বদরখালী ইউনিয়নের মধ্যে। বদরখালীর বাজার পাড়া, মগনামাপাড়ায় নদী রক্ষা বাঁধের পাশ ঘিরে অসংখ্য বাড়িঘর এখন। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে বন ছিল একসময়।
হাফিজুর রহমান বলেন, ‘চোখের সামনে বনটা শ্যাষ হয়ে গেল। সরকার তো বলছে, তাদের লাভ হয়েছে। মাছ বিক্রি করে লাভ হয়েছে। আমরা তো লাভ দেখি না। যারা মাছের চাষ করছে, তারা চলে গেছে। এখানকার মানুষ তো কিছু পায় নাই কষ্ট ছাড়া।’
একটি মুদিদোকানে কথা বলার সময় হাফিজুর রহমানকে ঘিরে ছিলেন অনেকেই। সেখানে অল্প বয়সী ছেলেদের বন নিয়ে কৌতূহল দেখে গল্পের ঝাঁপি খুললেন হাফিজুর। এ বনে বাঘের ডাক শোনা, হরিণের বিচরণ দেখা, মাছ ধরার স্মৃতিতে তখন মশগুল মধ্যবয়সী হাফিজুর আর তাঁর সামনে থাকা অনেকগুলো বিস্ফোরিত চোখ। যে বন নিয়ে এ গল্প, তা আর কোনো দিনই ফিরবে না।
সত্যিই কি ফিরবে না? কেউ কেউ মনে করেন, সম্ভব। বন একবার শেষ হলে তা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব কিছু নয়। বিশেষ করে ম্যানগ্রোভের ক্ষেত্রে। তবে চকরিয়ার মাটি এতটাই দূষিত যে সেখানে বন ফিরিয়ে আনা জটিল। অনেকেই লবণের লাভ কিংবা বর্ষার সময়ে মাছ চাষ করে লাভের আশা ছাড়তে চাইবে না। সেখানে সরকার যদি কঠোর কোনো অবস্থান নিয়ে বনের ইজারা বাতিল করে, তবে বনকে কয়েক বছর নিরুপদ্রব রেখে বন আবার ফেরানো সম্ভব বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ আল-আমিন।
একসময়ের চকরিয়া সুন্দরবন বলতে যা বোঝায়, তা কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের আওতায় পড়েছে। এর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মারুফ হোসেন জানান, চকরিয়া সুন্দরবনে জমি ইজারা দেওয়া হয়েছিল চিংড়ি চাষের নামে। এখন সেখানে বন ফিরিয়ে আনতে হলে সেটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এ জন্য প্রথমে যে ইজারা দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল করতে হবে। এটা নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। কিন্তু সেখানে বনায়নের কোনো উদ্যোগ আপাতত নেই। তবে চকরিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ পরিচালনা করার জন্য একটি প্রস্তাব কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের কাছে ২০২০ সালে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে নির্দেশ পেলে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হতে পারে।