ঘূর্ণিঝড়ে সাগরের পাখিরা পদ্মায়

জোয়ানিনস প্যাট্রল নামের পাখিটি বাংলাদেশের জন্য নতুন পাখি। ২৯ মে পাখিটির ছবি পদ্মার মাওয়া অংশ থেকে তুলেছেন মোহাম্মদ শাহানশাহ বাপ্পী

মে মাসের শেষ ভাগে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বড় বড় ঝড় হচ্ছে। কদিন আগে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাব আমরা দেখেছি। ঝড়টির ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন এখন সব জায়গায়। সুন্দরবন আর উপকূলের সবুজ বেষ্টনী না থাকলে হয়তো দক্ষিণাঞ্চলের ক্ষতি আরও বেশি হতো। এরই মধ্যে প্রায় কয়েক শ পশুপাখির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। ঝড়ের মৌসুমে আমরা শুধু ঘরবাড়ির হিসাব রাখি, কতগুলো বাঁধ ভাঙল তার হিসাব রাখি। সাধারণ মানুষের কাছে অন্য সব খবর গৌণ।

২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর পাঁচটি নতুন পাখি পদ্মায় দেখা গিয়েছিল। সব পাখিই গভীর সাগরের। এই পাখিগুলো কখনো নদীতে দেখা যায়নি। ওই বছরের ২১ ও ২২ মে চারটি পাখি রাজশাহী শহরের খুব কাছাকাছি দেখা গিয়েছিল।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতের পরও এ রকম খবর পাওয়া গেল। গত ২৮ ও ২৯ মে পদ্মা নদীতে দেখা গেল গভীর সাগরের পাঁচটি পাখি। এর মধ্যে জোয়ানিনস প্যাট্রল নামের একটি পাখি দেখা গেছে, যা বাংলাদেশের জন্যই নতুন। পাখিটি মূলত ভারত সাগরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে দেখা যায়। খুবই বিরল জাতের পাখিটি সম্পর্কে গবেষকদেরও খুব বেশি জানা নেই। তবে পৃথিবীতে ২ হাজার ৫০০টির মতো এই পাখি টিকে আছে বলে ধারণা করা হয়।

দ্বিতীয় পাখিটির নাম স্যুটি পানচিল। আম্পান আর রিমালের পর পাখিটিকে পদ্মা নদীতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে ১২ জাতের পানচিল আছে; কিন্তু গভীর সাগরের কোনো পানচিলের পদ্মায় দেখা মেলে না। স্যুটি পানচিল সব পানচিল থেকে আলাদা এক স্বভাবের পাখি। প্রথম আবাসস্থল থেকে বের হওয়ার পর কমপক্ষে চার-পাঁচ বছর এরা ডাঙায় নামে না। এমনকি তারা সাঁতার কাটতেও পারে না। কারণ, তাদের জলনিরোধক পালক নেই। জাপানের একটি দ্বীপে এই প্রজাতির এক লাখ পাখির একসঙ্গে বাসা বানানোর রেকর্ড আছে।

তৃতীয় পাখিটির নাম ওয়েডজ টেইল সেয়ারওয়াটার। প্রথমবার ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর ঢাকা শহরের লালমাটিয়া এলাকার একটি ছাদ থেকে এর দেখা পেয়েছিলেন পাখিদেখিয়ে বন্ধু সেথ মিলার। আর রিমালের পর পদ্মায় দেখা গেল শর্ট ট্রেইল সেয়ারওয়াটার। এ পাখিটিও গভীর সাগরের। পৃথিবীতে বেশ ভালো সংখ্যায় এখনো টিকে আছে। দেখা যায়, মূলত প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরে। প্রজনন মৌসুমের জন্য এ পাখির পছন্দ পূর্ব ও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার উপকূল।

ইউলস’স স্টর্ম প্যাট্রল নামের এই গভীর সাগরের পাখিটির ছবি ঘূর্ণিঝড় রিমালের পর পদ্মা নদী থেকে তুলেছেন মোহাম্মদ শাহানশাহ বাপ্পী

চতুর্থ পাখিটির নাম ইউলস’স স্টর্ম প্যাট্রল। এই গোত্রের প্রথম কোনো পাখি বাংলাদেশের সীমানায় দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। পাখিটির নামকরণ হয়েছে এক স্কটিশ আমেরিকান ভদ্রলোক ইউলসের নামে। গোটা দুনিয়ার সবচেয়ে ছোট্ট সামুদ্রিক পাখির মধে৵ একটি এটি। দেখা যায় মূলত অ্যান্টার্কটিকার উপকূলীয় অঞ্চল, উত্তর আটলান্টিক, ভারত মহাসাগর ও কোনো কোনো সময় প্রশান্ত মহাসাগরে। এরা মূলত পাথুরে সাগরের দ্বীপগুলোয় দল বেঁধে ডিম দেয় ও সংসার সাজায়। প্রজনন মৌসুমে এরা একেবারেই রাতচরা। এমনকি চাঁদের রাতও তারা পছন্দ করে না। এর বড় কারণ হলো, তাদের ডিমগুলো যেন কোনো শত্রু এসে খেয়ে না ফেলে। রিমালের পর দেখা গেছে পদ্মায়।

ব্রিডলেড টার্ন নামের এই গভীর সাগরের পাখিটির ছবি ঘূর্ণিঝড় রিমালের পর পদ্মা নদী থেকে তুলেছেন মোহাম্মদ শাহানশাহ বাপ্পী

পঞ্চম পাখিটির নাম ব্রিডলেড টার্ন। গোটা দুনিয়ায় এক মিলিয়নের মতো এ পাখি দেখা যায়। আমাদের দেশের পাতিপানচিল আকারের এই পাখির বসবাস মূলত ট্রপিক্যাল সাগরে। তবে প্রজনন মৌসুমে আটলান্টিক ও প্রশান্ত সাগরে আসে। স্যুটি পানচিলের সঙ্গে এরাও একসঙ্গে দল বেঁধে বাসা বানায়।

এর বাইরে আম্পানের সময় আরেকটি পাখি দেখা গিয়েছিল। পাখিটির নাম লং টেইল জিগার। সারা দুনিয়ায় এর সংখ্যা দুই থেকে সাত লাখের মতো। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বিভিন্ন দ্বীপে এরা প্রজনন মৌসুম কাটায়। প্রজনন মৌসুম ছাড়া এরা সাধারণত স্থলভাগে খুবই কম আসে। এক জাতের ছোট্ট ইঁদুর এদের জন্য হুমকি। কোনো দ্বীপে যদি ইঁদুরের সংখ্যা বেশি থাকে, তবে এদের সংখ্যা একেবারেই কমে যায়।

ঝড়ের তাণ্ডবে গভীর সাগরের এই পাখিগুলো দিগ্‌বিদিক ছুটতে ছুটতে পথ ভুলে আমাদের নদীতে এসেছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের উৎপত্তিস্থল ও তার গতিবিধি দেখলে বোঝা যায়, পাখিগুলো ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে ওপরের দিকে উঠে এসেছে। বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল দুজন পাখিবিজ্ঞানী গ্যারি ওলপোর্ট আর ডিংলি ওয়াং এখন বাংলাদেশে। তাঁরাও এই পাখিগুলো দেখতে মাওয়া এলাকায় পদ্মা নদীতে গিয়েছিলেন। গভীর সাগরের এই পাখিগুলো দেখে তাঁরা অবাক হয়েছেন। পাখিগুলো খুব দ্রুত ফিরে যাবে সাগরে। এখন ওরা খুবই ক্লান্ত। পাখিগুলোকে বিরক্ত না করার অনুরোধ রইল।