এসো শ্যামল সুন্দর

কদম ফুলকে বলা হয় বর্ষার দূত। কদম ফুল নিয়ে স্কুল থেকে ঘরে ফিরছে দুই বন্ধু। গতকাল রংপুর নগরের নিউ ইঞ্জিনিয়ার পাড়ায়
ছবি: মঈনুল ইসলাম

এসো শ্যামল সুন্দর,/ আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।/ বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে।—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

জলবতী মেঘের বাতাস নিয়ে বর্ষা এল বাংলার সঘন সজল প্রকৃতিতে। আজ পয়লা আষাঢ়, বর্ষা ঋতুর প্রথম দিন। ‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।/ ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’ ষড়্‌ঋতুর এই দেশে গ্রীষ্মের পরই বর্ষা আসে থইথই জল-জোছনায় মাখামাখি হয়ে। মাঠ-ঘাট, নদ-নদী, খাল-বিল সবখানে জলেরই উল্লাস, জলেরই খেলা।

বর্ষা মোটেই শরতের মতো পঞ্জিকার পাতার অদেখা ঋতু নয়। বাঙালির জীবনে বর্ষার রয়েছে তীব্র উপস্থিতি। কেবল কাব্যে, সংগীতে, চিত্রকলায় নয়, এখানকার মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে বর্ষা। এই মিশে থাকা যেমন একান্ত উপলব্ধির জায়গা থেকে, তেমনি এর আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন বাঙালির হৃদয়-মনকে মথিত করে প্রবলভাবে।

বৃষ্টির সঙ্গে জলের রুপালি শস্য ইলিশের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ইদানীং ইলিশ নিয়ে সেই আবেগ কিছুটা ফিকে হতে চলেছে কি? খিচুড়ির সঙ্গে দুটো বেগুনভাজা, আর একটা মরিচ পোড়া হলেই তো দিব্যি চলে যায়।
এই আষাঢ়ে ‘নবযৌবনা বরষা’রই প্রত্যাশা এখন বাঙালির মনে, বাংলার প্রকৃতিতে
প্রথম আলো ফাইল ছবি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সোনার তরী’ কবিতায় সেই বর্ষারই অপরূপ ছবি এঁকেছেন। গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা, বৃষ্টির পানিতে ভরা নদী, চারদিকে নদীর বাঁকাজল, প্রভাতবেলার মেঘে ঢাকা গ্রাম। আর সঙ্গে তো আছেই কদম, কেয়া, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার যত হাসি।

গ্রীষ্মে প্রকৃতি থাকে ঊষর, খরতাপে দগ্ধ ধরাতল। এবার যেন চিরাচরিত সেই গ্রীষ্মের পাণ্ডুলিপিই লিখেছিলেন ভাগ্যবিধাতা। প্রকৃতির রুদ্ররূপ দেখা গেছে চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠজুড়ে। জ্যৈষ্ঠের শেষ দিকে কালো মেঘ এসে বৃষ্টি ঝরালেও তাতে তৃষ্ণা মেটেনি বৃক্ষরাজি, মানুষ আর প্রাণিকুলের। এই আষাঢ়ে ‘নবযৌবনা বরষা’রই প্রত্যাশা এখন বাঙালির মনে, বাংলার প্রকৃতিতে।

তবে কখন তিনি কৃপা দেবেন, আগাম বলার তো সুযোগ নেই। গত বছর যেমন আষাঢ়, শ্রাবণ পেরিয়ে অনেকটা ভাদ্রে তিনি দেখা দিলেন! এবার অবশ্য আবহাওয়াবিদেরা বর্ষার ঠিকুজি-কুষ্ঠি বের করে বলছেন, জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ সক্রিয় হচ্ছে যথাসময়ে। বর্ষা এবার ধরা দেবেন নিজ সীমারেখায়।

বর্ষাকালে অনবরত বৃষ্টি যাঁদের কিছু অবসর আছে, তাঁদের কাছে যতটা মধুর, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য উল্টো চরম ভাগ্যবিড়ম্বনার

কিন্তু সেই বর্ষার কি আর দেখা মেলে? অবিশ্রান্ত বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। উঠান-বাড়ি, সড়ক, মাঠ, নালা, পুকুর জলে ভরোভরো।

একটা কথা প্রচলিত ছিল, ‘শনির সাত, মঙ্গলের তিন, আর সব দিন দিন।’ অর্থাৎ শনিবার বৃষ্টি শুরু হলে তার মেয়াদ হবে সাত দিন। টাপুরটুপুর রাতদিন পড়তেই থাকবে। মঙ্গলবার বৃষ্টি শুরু হলে চলবে তিন দিন। আর বাকি দিনগুলোয় বৃষ্টি দিনে এসে দিনে বিদায় নেবে। কিন্তু সেই বৃষ্টি এখন আর নেই। আবহাওয়াবিদদের মতে, এসবই বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাবের ফল।

বৃষ্টি মানেই রাশি রাশি সুখস্মৃতির খুলে যাওয়া জানালা! হঠাৎ বৃষ্টিতে বইখাতা প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়িয়ে, মানকচুর পাতায় মাথা ঢেকে কাদার সড়ক পেরিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা, মফস্‌সলের শিশু-কিশোরদের জীবনে আজও আনন্দের উপলক্ষ। পার্থক্য একটাই—আজ ততটা ভেজা মাটির সড়ক দেখা যায় না। ভরা পুকুরের জলে ডুব দিয়ে বৃষ্টির গান, কিংবা টিনের ঘরে বসে বৃষ্টির একটানা খেয়াল-ঠুমরি শোনা, শেষ বিকেলে বৃষ্টিধোয়া আকাশে হংস-মিথুনের উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা—এসব অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তারপরও বর্ষা এমন সব আনন্দ-স্মৃতিরই এক সজল পাঠাগার।

শহরে বর্ষাকালের কদর অন্য রূপে। মায়েরা সন্তানদের বৃষ্টিতে ভিজতে দেন না একেবারেই; কারণ, সর্দি-জ্বর-ইনফ্লুয়েঞ্জার ভয়। এর মধ্যেই কোনো কিশোরী-তরুণীর দল খোলা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে দ্বিচক্রযানে বৃষ্টি-ভ্রমণে বের হলেই দুষ্টু আলোকচিত্রীদের ক্যামেরার শাটারে হাত পড়বেই।

বাঙালির রসনাতৃপ্তিতেও বৃষ্টি আছে, প্রবলভাবে। বৃষ্টি এলে কিংবা দিনটা যদি মেঘমেদুর হয়, অনেক ঘরেই ছড়িয়ে পড়ে খিচুড়ির ঘ্রাণ। ফেসবুকের ওয়ালজুড়ে সে ছবি। অন্য গৃহনিপুণারাও নড়েচড়ে বসেন। বসে থাকে না রেস্তোরাঁগুলোও। সেখানেও চলে ‘বৃষ্টিভোজে’র যত প্ররোচনা। যুগটা যখন ডিজিটাল, অ্যাপে ফরমাশ দিলেই একেবারে গরম-গরম খানাপিনা হাজির ঘরের দরজায়।

বৃষ্টির সঙ্গে জলের রুপালি শস্য ইলিশের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ইদানীং ইলিশ নিয়ে সেই আবেগ কিছুটা ফিকে হতে চলেছে কি? খিচুড়ির সঙ্গে দুটো বেগুনভাজা, আর একটা মরিচ পোড়া হলেই তো দিব্যি চলে যায়। এর একটা কারণ হতে পারে মহার্ঘ বস্তুটির অগ্নিমূল্য। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা বাঙালি মধ্যবিত্তের ইলিশ-রোমাঞ্চ অনেকটা শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য বোধ করি ওই একটি কারণই যথেষ্ট।

বর্ষাকালে অনবরত বৃষ্টি যাঁদের কিছু অবসর আছে, তাঁদের কাছে যতটা মধুর, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য উল্টো চরম ভাগ্যবিড়ম্বনার। সারা দিন বসে থেকেও কাজ জোটে না। ফুটপাতের দোকানে বেচাকেনা কমে যায়। ঝোড়ো বাতাসে ভেঙে পড়ে দোকানের ত্রিপলের ছাউনি। খেতে-মাঠে কৃষকের মৃত্যু ঘটে বজ্রাঘাতে। তবু কৃষকের বসে থাকার উপায় নেই। এই বর্ষা শুধু তাঁর জন্যই না, মানুষের মুখে মুখে অন্ন জোগানোর দায়টাও তো তাঁরই। ধানের বীজতলা তৈরি, জমি প্রস্তুত করা, সবই এই বর্ষারই কাজ।

বর্ষার ফুল, ফল, কবিতা আর গানের কথা মনে করতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। দূর হতে যেন ভেসে এল কাজী নজরুল ইসলামের সেই গান, ‘সখী বাঁধো লো বাঁধো লো ঝুলনিয়া/ নামিল মেঘলা মোর বাদরিয়া।’