ব্লুবেলের অফুরন্ত উচ্ছ্বাস

স্কটিশ ব্লুবেল ফুল। জার্মানির হেকলিঙ্গেন থেকে
ছবি: লেখক

কিছুদিন আগেও জার্মানির হেকলিঙ্গেন শহরে তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৩৭ ডিগ্রি। গত কয়েক দিন ধরেই প্রবল বাতাস বইছে। এখন বৃষ্টির দেখা পাব বলে মনে হচ্ছে। সেই সঙ্গে আকাশে নীলের অফুরন্ত উচ্ছ্বাস। বনের কোনো কোনো বৃক্ষের পাতাগুলো তামা বর্ণের রূপ ধারণ করছে। শরৎ অতি আসন্ন। সকালের মিষ্টি রোদে বাইরে বেরিয়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে বেশ ভালো লাগে। শহরে পাখির কলতানে চারদিক মুখর থাকে।

এখানে শালিকগুলো শহর ছেড়ে এখন মাঠের দিকেই থাকে। শালিকের ডাকাডাকি ও চঞ্চলতা খুব মিস করি। প্রতিদিন শ দুয়েক রকের (এক প্রজাতির কাক) সঙ্গে দেখা হয়। এই কাকগুলো খুব লাজুক। কাছে যাওয়ার আগেই উড়ে যায়।

তা ছাড়া সকালে অফিসে যাওয়ার পথে কংক্রিটের ফুটপাতে গ্রীষ্মে ফোটা কয়েক ধরনের বুনো ফুল অভিবাদন জানায়। এসব বুনো ফুলের অনেক প্রজাতিই অচেনা। এরপরও তাদের প্রস্ফুটন বাংলার বুনো ফুলের মতোই উজ্জ্বল ও প্রেমময়।

প্রায় এক মাস ধরে হেকলিঙ্গেন শহরের ২০ মিটার দীর্ঘ ফুটপাতে ছোট্ট একটি বীরুৎ–জাতীয় উদ্ভিদে ফুটে আছে নীল রঙের ঘণ্টা আকারের ফুল। পুরো শাখা-প্রশাখা ঢেকে গেছে ফুলের রঙে। প্রবল বাতাসে ফুলগুলো দোলে, কিন্তু ঝরে পড়ে না। প্রথম কিছুদিন খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করিনি।

একদিন সকালে মনে হলো ফুলটিকে সময় দিই। কারণ, সকালে তাকে দেখার পরই মনটা ভালো হয়ে যায়। পাখি গবেষণার কাজে ইতিমধ্যে ওই এলাকাটা চষে বেড়িয়েছি। তবে অবাক হলাম আশপাশের গমখেত, পতিত জায়গা, গাছের তলায় এ ফুলের আর কোনো গাছ দেখলাম না।

অনেক দিন ধরেই ফুলটির নীল রঙের উচ্ছ্বাস গাছে লেগে থাকে। ভাবছি বারান্দার টবে বীজ সংগ্রহ করে চারা তৈরি করব। এর একাধিক ইংরেজি নাম রয়েছে। যেমন ব্লুবেল, হারবেল, স্কটিশ ব্লুবেল, বেলফ্লাওয়ার। এই ভেষজ বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদকে উত্তর গোলার্ধের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলজুড়ে পাওয়া যায়। গ্রীষ্মের শেষের দিক থেকে শরৎকাল অবধি বেগুনি-নীল, ঘণ্টা-আকৃতির ফুল উৎপাদন করে। ১৭৫৩ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস প্রথম এই উদ্ভিদের বর্ণনা করেন।

উদ্ভিদটি প্রায় ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উচ্চতায় পৌঁছায়। এর পাতাগুলো লম্বা-বৃন্তযুক্ত ও দন্তর। ফুলের কাণ্ডের পাতা লম্বা, সরু এবং ওপরের পাতাগুলো ডালবিহীন। পুষ্পবিন্যাস প্যানিকেল বা রেসিম। ফ্যাকাশে থেকে মধ্য বেগুনি-নীল পাপড়িগুলো একত্রে একটি ঘণ্টার আকারে মিশে থাকে। পাপড়ির লোবগুলো ত্রিভুজাকার এবং বাইরের দিকে বক্র।

এটির বৈজ্ঞানিক নাম Campanula rotundifolia। ফুলের সময়কাল দীর্ঘ এবং অবস্থান অনুসারে পরিবর্তিত হয়। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ব্লুবেল ফুল ফোটে। ফুল মৌমাছি দ্বারা পরাগায়িত হয়, কিন্তু স্বপরাগায়নও করতে পারে।

ব্লুবেল তৃণভূমিতে জন্মায়। পাথুরে মাটিতেও বাড়তে পারে। অনেক ব্লুবেল মিলে বাগানে নীল কার্পেটের মতো দৃশ্য তৈরি করে। ব্লুবেল ইউরোপীয়দের অত্যন্ত প্রিয় ফুল। অনেক পশ্চিমা কবি তাঁদের কবিতায় এ ফুলের কথা বলেছেন।

বন্য মৌমাছি এবং অন্যান্য পোকামাকড় এ ফুলে বিচরণ করে। জার্মানদের বাগানে এ ফুল খুব কমই পাওয়া যায়। তবে এ ফুলের সুন্দর নীল রং ও গড়ন মানুষের হৃদয়কে আনন্দিত করতে পারে।

সৌরভ মাহমুদ, প্রকৃতিবিষয়ক লেখকপরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার