ঝাঁকে চলা দামাদের গল্প

উড়ে যাচ্ছে দামা। জার্মানির হেলিঙ্গেন থেকে
ছবি: লেখক

ঝকঝকে রোদ। একটু পরই আবার বাতাসে মেঘ ভেসে এসে প্রকৃতিকে ঢেকে দেয়। মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায় গাছপালা ও ফসলের খেত। এখন জার্মানির প্রকৃতিতে রোদ আর মেঘের এমন লুকোচুরি প্রায় প্রতিদিনের। বসন্ত আসতে আরও প্রায় এক সপ্তাহ বাকি, যে কারণেই এমন খেলা।

ইতিমধ্যে দুই প্রজাতির ঘাসে নীল ও হলুদ রঙের ফুল ফুটেছে। শীতের সময় আবাস ছেড়ে যাওয়া অনেক পাখিই ঘাস বনে ও বৃক্ষের বনে ফিরে আসতে শুরু করেছে। তিন প্রজাতির টিট পাখি গান গাওয়া শুরু করেছে সঙ্গিনীর জন্য। এসবই বসন্তের আগমনী বার্তার ইঙ্গিত।

মেঘ ও রোদের এ লুকোচুরির মধ্যেই পাখি দেখতে মাঝেমধ্যে বের হই। শহর ছেড়ে গ্রামের দিকের ঘাস ও বৃক্ষের বনে এক কিলোমিটার হাঁটলে যে খুব বেশি প্রজাতির পাখির দেখা পাব, এমনটা নয়। এমন শীতে কেবল শালিক ও টিট প্রজাতির পাখিই চোখে পড়ে।

ঘাসের মাঠে দামা। জার্মানির হেলিঙ্গেন থেকে
ছবি: লেখক

সম্প্রতি পাখি দেখতে গিয়ে দেখা হয় থ্রাস পরিবারের পাখির সঙ্গে। বাংলায় এদের আমরা দামা নামেই চিনি। যেমন কমলা দামা, নীলচে দামা ইত্যাদি। আমাদের বনে অনেক প্রজাতির দামা আছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই পরিযায়ী। দামারা মূলত একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে।

তবে জার্মানির একটি ঘাসের ভূমিতে যে দামা পরিবারের পাখির সঙ্গে দেখা হলো, তারা দলে চলে। একঝাঁকে দু-তিন শ দামা দেখার ভাগ্য আগে কখনো হয়নি। ভাবিনি দামারাও এ রকম বড় দলে চলে! আসলে পাখির জগৎ সম্পর্কে জানতে হলে মাঠে-ঘাটে পাখি দেখতে যেতে হবে। থ্রাস পরিবারের এ প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম Turdus pilaris। ইংরেজি নাম ফিল্ডফেয়ার। জার্মান ভাষায় এ পাখির নাম হলো ভাখহোল্ডারড্রোসেল।

দামার এ প্রজাতিদের ঝাঁক চার দিন চোখে পড়েছে। লক্ষ করে দেখলাম এরা লাজুক স্বভাবের পাখি। মানুষের উপস্থিতি কম এমন নিরাপদ ঘাসের মাঠে এরা বিচরণ করে এবং খুঁজে খুঁজে খাবার খায়। খাবার খাওয়ার সময় কর্কশ স্বরে ডাকে। দলের কয়েকটি উড়ে গেলে বাকিরাও তাদের অনুকরণ করে। এরা সামাজিকভাবে বসবাস করে। মাঝেমধ্যে দামাদের দলের মধ্যে চিত্রা শালিকও দেখা যায়। একসঙ্গে মাঠে চরে খাবার খায়। শিকারি পাখিরা উড়ে এলে দামারা লম্বা কোনো বার্চগাছে গিয়ে বসে। কখনো অনেক দূরে উড়ে যায়। এরা ধীরগতিতে উড়ে। উড়ে গিয়ে গাছের ওপরের ডালে বসে এবং সবাই একই দিকে মুখ করে থাকে।

দামারা উত্তর ইউরোপের বনভূমি ও গুল্মের ঝোপে বংশবৃদ্ধি করে। তবে এরা পরিযায়ী পাখি। বছরের নানান সময়ে আবহাওয়া ও খাবারের প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে ভ্রমণ করে। উত্তরের পাখি শীতকালে দক্ষিণে চলে যায়। প্রধানত এরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ও রাশিয়ার বিরাট অংশে পরিযায়ী হয়। তবে মাঝেমধ্যে চীন, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যর কোনো কোনো দেশে উড়ে যায়।

এরা সর্বভুক। গ্রীষ্মকালে শামুক, গুগলি, পোকামাকড়, কেঁচো এবং শীতকালে বেরি, শস্য ও বীজ খায়। গ্রীষ্মকালে এ পাখি বার্চ, অ্যাল্ডার, পাইন, স্প্রুস এবং ফারের মিশ্র বনভূমির কাছে খোলা মাঠে বসবাস করে। শীতকালে প্রধানত খোলা প্রান্তর, কৃষিজমি, ছোট ঘাসময় জমি ও খোলা বনভূমিতে পাওয়া যায়।

  • সৌরভ মাহমুদ, প্রকৃতিবিষয়ক লেখকপরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার