ঢাকাসহ দেশের কোন কোন শহরে দূষণ বেশি, কারণ কী
রংপুর শহরের তেঁতুলতলা থেকে লালবাগের হাট এবং ডিসির মোড় থেকে ক্যান্টনমেন্ট মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে একসময় বড় বড় গাছ ছিল। শহরের সৌন্দর্য বাড়াতে এসব গাছ লাগানো হয়েছিল ১৯১৪ থেকে ১৯১৬ সালের মধ্যে। রংপুরের কারমাইকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়ই এসব গাছ লাগান তখনকার জেলা প্রশাসক জে এন গুপ্ত। শহরটিতে শিক্ষার প্রসার আর এর নান্দনিকতা বাড়াতে সবুজায়ন প্রায় সমসাময়িক ঘটনা, জানালেন বৃহত্তর রংপুরের ইতিহাস বইয়ের লেখক মোস্তফা তোফায়েল হোসেন। তিনি বলেন, ‘দেড় থেকে দুই দশকে শহরের এসব শতবর্ষী গাছ কেটে সাফ করা হয়েছে। গাছ ঝুঁকিপূর্ণ হলে কাটতে হয়। কিন্তু এর বিপরীতে তো গাছ লাগাতে হবে। সেটা তো হয়নি।’
ঠিক যে সময়টায় উত্তরের এই জনপদ থেকে বড় গাছগুলো হারিয়ে যেতে শুরু করেছে, সে সময় থেকেই শহরটির বায়ুদূষণ বেড়ে গেছে। অথচ এ শহরে বা আশপাশে কলকারখানা তেমন নেই। শহরটির দূষণ এখন দেশের সবচেয়ে বেশি দূষিত নগরী ঢাকার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
ঢাকায় এখন যে অবস্থা, তাতে অবশ্যই জনসাধারণকে অন্তত জরুরি বার্তা দেওয়া উচিত। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় কিংবা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিন্দুমাত্র কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে নাক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার
রংপুর শহরজুড়ে এখন যেসব গাছ আছে, এর বেশির ভাগের বয়স বড়জোর ১০ বছর। এ তথ্য জানিয়ে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলছিলেন, ‘শহরের প্রতি ২০০ মিটারের মধ্যে একটি করে স্থাপনার নির্মাণকাজ চলছে। এসব কাজের ফলে ছড়াচ্ছে ধুলাবালু। কিন্তু এই দূষণ রোধে যে গাছপালা থাকা দরকার, তার কিছুই নেই।’
শুধু রংপুর নয়, উত্তরের আরেক নির্মল বাতাসের শহর পদ্মাপারের রাজশাহী, ব্রহ্মপুত্রের সৌন্দর্যভরা ময়মনসিংহ, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কিংবা দক্ষিণের জনপদ খুলনা—বায়ুদূষণ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। দূষণের সঙ্গে বেড়েছে এর প্রভাবে হওয়া শ্বাসকষ্টজনিত নানা রোগ। দূষণ রোধে সরকারি তৎপরতা নেই বললেই চলে। প্রকল্পের পর প্রকল্প আর নানা নীতিমালার ভারে দূষণ বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।
নভেম্বরে সর্বোচ্চ দূষণ
দিন যত যাচ্ছে, ঢাকার বায়ুদূষণ ততই বাড়ছে। গত নভেম্বরে ঢাকা নগরীতে বায়ুদূষণ ছিল গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বায়ুর এ মান পর্যবেক্ষণ করে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আট বছর (২০১৬-২০২৩) নভেম্বর মাসে ঢাকার বায়ুমান সূচক বা একিউআই ছিল ১৭৬ দশমিক ৬৬। এ বছরের নভেম্বরে এ মান ১৯৫। অর্থাৎ এবার নভেম্বর মাসে বায়ুর গড় মান গত ৯ বছরের চেয়ে ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। আর ২০২৩ সালের তুলনায় বায়ুমান সূচক ১১ দশমিক ৫ ভাগ বেড়ে গেছে।
গবেষণা অনুযায়ী, গেল নভেম্বরে ঢাকার মানুষ এক দিনও ভালো বা নির্মল বায়ুতে নিশ্বাস নিতে পারেনি। নভেম্বরে এক দিন বায়ুমান ছিল ‘মধ্যম’ প্রকৃতির। চার দিন বায়ুমান ছিল ‘সতর্কতামূলক’। ১২ দিনের বায়ুমান ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’ আর ১৩ দিনের বায়ুমান ছিল ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’।
নভেম্বরের চেয়েও চলতি ডিসেম্বরে ঢাকার বায়ুর অবস্থা অনেক নাজুক। গত ৯ দিনে এক দিনও ঢাকার বায়ুর মান ভালো ছিল না। বরং ৫ ডিসেম্বর বায়ুর মান ছিল চলতি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে সেদিন সকাল ৯টার দিকে ঢাকার স্কোর ছিল ৩৪১। ওই দিন টানা প্রায় ৯ ঘণ্টা বাতাসের মান ৩০০–এর বেশি ছিল। গতকাল সোমবার ভোর ৪টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত টানা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বায়ুর মান ৩০০–এর ওপরে ছিল।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো এলাকায় টানা তিন দিন তিন ঘণ্টা ধরে একটানা বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি থাকলে সেই এলাকায় স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করা উচিত। ঢাকায় এখন যে অবস্থা, তাতে অবশ্যই জনসাধারণকে অন্তত জরুরি বার্তা দেওয়া উচিত। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় কিংবা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিন্দুমাত্র কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।’
নির্মল শহরে এত দূষণ কেন
২০১৬ সালে রাজশাহীর নাম আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে আসে। সে বছর ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের যে কয়টি শহর মানবদেহের জন্য বাতাসে ভেসে থাকা ক্ষতিকর বস্তুকণা কমিয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে রাজশাহী ছিল প্রথম। ২০১৪ থেকে ২০১৬–এর মধ্যে রাজশাহীতে এ ধরনের বস্তুকণার পরিমাণ ৬৭ শতাংশের বেশি কমেছিল। বিশ্বে এমন সফল নগরীর মধ্যে দ্বিতীয় ছিল ইরানের শহর আহভাজ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উপাত্ত তুলে ধরে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইটভাটার ওপর কড়াকড়ি, ব্যাপক সবুজায়ন, ব্যাটারিচালিত যানের প্রসার—এসবই নগরীর বায়ু নির্মল হওয়ার কারণ।
রাজশাহী শহরে দূষণ অনেক বেড়ে গেছে। গতকাল সকালে আইকিউএয়ারে এই নগরীর বায়ুর মান ছিল ১৭০। এই মানকে অস্বাস্থ্যকর ধরা হয়।
কিন্তু সেই সুদিন আর নেই। রাজশাহী শহরে দূষণ অনেক বেড়ে গেছে। গতকাল সকালে আইকিউএয়ারে এই নগরীর বায়ুর মান ছিল ১৭০। এই মানকে অস্বাস্থ্যকর ধরা হয়।
পরিবেশবিশেষজ্ঞ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান বলেন, একটা সময় ছিল, যখন পদ্মার ধূলি ব্যাপকভাবে ছড়াত। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিটি করপোরেশন সবুজায়নের কাজ করে। এতে কয়েক বছরের মধ্যে দূষণের মাত্রা কমে যায়। কিন্তু চার থেকে পাঁচ বছর ধরে দূষণের পরিমাণ বাড়ছে। এর কারণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ। নির্মাণকাজের ব্যবস্থাপনা বলে কিছু নেই। এ ছাড়া দূষণ রোধে কোনো তৎপরতাও দেখা যায় না।
দূষণ ছড়াচ্ছে অন্য শহরেও
দূষণ পরিমাপের একটি একক হচ্ছে অ্যারোসল অপটিক্যাল ডেপথ (এওডি)। এওডির মধ্যে আছে ধুলাবালু, জীবাশ্ম জ্বালানির পোড়া উপাদান, কলকারখানার ধোঁয়াসহ নানা উপাদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ ২০২১ সালে কৃত্রিম উপগ্রহের সহায়তায় দেশের ছয়টি শহরের এওডি পরিমাপ করে। শহরগুলো হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট। এই গবেষণায় এক দশকের বায়ুদূষণের প্রবণতা দেখার চেষ্টা করা হয়। গবেষণাটি অ্যাটমোস্ফিয়ারিক রিসার্চ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, ছয় শহরের মধ্যে সর্বোচ্চ এওডি মান ছিল রাজশাহী, শূন্য দশমিক ৭৮। আর এরপর ছিল খুলনা, ঢাকা, বরিশাল, সিলেট ও চট্টগ্রাম।
চার থেকে পাঁচ বছর ধরে দূষণের পরিমাণ বাড়ছে। এর কারণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ। নির্মাণকাজের ব্যবস্থাপনা বলে কিছু নেই। এ ছাড়া দূষণ রোধে কোনো তৎপরতাও দেখা যায় না।পরিবেশবিশেষজ্ঞ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান
গবেষক ও বুয়েটের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক শাহিদ উজ জামান প্রথম আলোকে বলেন, এওডির উচ্চমান প্রমাণ করে যে দেশের প্রায় সব বড় শহরে দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। এই শুষ্ক মৌসুমে আন্তমহাদেশীয় দূষিত বায়ু বাংলাদেশের বায়ুদূষণে প্রভাব ফেলে, এটা ঠিক। কিন্তু এর পাশাপাশি নির্মাণকাজের ধূলিকণা, ইটভাটা এবং যানবাহনের দূষিত ধোঁয়ার মতো উৎসগুলোও দূষণ ঘটায়। এসব উৎস নিয়ন্ত্রণে ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোর দিকেও মনোযোগ দেওয়া উচিত।
নভেম্বরে দেশের শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছিল নারায়ণগঞ্জে, বায়ুমান সূচক ছিল ২০৫। এরপরই ১৯৫ স্কোর নিয়ে ছিল ঢাকা। গাজীপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও রংপুরের গড় সূচক ছিল যথাক্রমে ১৯১, ১৭৯, ১৬৭ ও ১৮৬। অর্থাৎ পুরো নভেম্বর মাস এসব শহরের মানুষের অস্বাস্থ্যকর বায়ুর মধ্যেই কেটেছে।
ধুঁকছে মানুষ, দেখার কেউ নেই
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের বহির্বিভাগে প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার রোগী দেখা হয়। বছর তিনেক আগেও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ১৫ থেকে ২০ জনের বেশি রোগী আসতেন না। কিন্তু এখন গড়ে ৭০ জনের বেশি রোগী দেখতে হয় বলে জানালেন এই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন এত রোগী হয় যে অনেককে ফেরত পাঠাতে হয়। দিন দিন শহরে যে হারে দূষণ বাড়ছে, তার সঙ্গে যে এর সম্পর্ক আছে, তা বলাই যায়। আমি যেখানে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করি, সেখানেও রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি দেখি। এটা এই শুকনো মৌসুমে আরও বাড়ে।’
নভেম্বরে দেশের শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছিল নারায়ণগঞ্জে, বায়ুমান সূচক ছিল ২০৫। এরপরই ১৯৫ স্কোর নিয়ে ছিল ঢাকা। গাজীপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও রংপুরের গড় সূচক ছিল যথাক্রমে ১৯১, ১৭৯, ১৬৭ ও ১৮৬। অর্থাৎ পুরো নভেম্বর মাস এসব শহরের মানুষের অস্বাস্থ্যকর বায়ুর মধ্যেই কেটেছে।
পরিবেশবিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যত্রতত্র নির্মাণকাজ, যানবাহন, কলকারখানার ধোঁয়া—এসব যেমন ঢাকার বায়দূষণের কারণ, তেমনি রাজধানীর বাইরের শহরেও বায়ুদূষণের জন্য এই নিয়মকগুলোই দায়ী। এসব উৎস বন্ধে কড়া পর্যবেক্ষণ দরকার। আর দরকার মানুষকে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা। এসব করার কথা পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর। কিন্তু ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে।
নগরের মধ্যে অস্বাভাবিক হারে নির্মাণকাজ বেড়ে যাওয়াকে দূষণের জন্য দায়ী মনে করেন পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুর বিভাগের পরিচালক এ কে এম রফিকুল ইসলাম। তবে দূষণ থেকে সুরক্ষায় ‘বড় আকারের’ কোনো কর্মকাণ্ড এখনো শুরু করেননি বলে জানান এই কর্মকর্তা।
এখন এত রোগী হয় যে অনেককে ফেরত পাঠাতে হয়। দিন দিন শহরে যে হারে দূষণ বাড়ছে, তার সঙ্গে যে এর সম্পর্ক আছে, তা বলাই যায়। আমি যেখানে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করি, সেখানেও রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি দেখি। এটা এই শুকনো মৌসুমে আরও বাড়েচিকিৎসক মো. আনিসুর রহমান