কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন শহরের ইনডিপেনডেন্স মনুমেন্টের কাছে ঘুরছিলাম। হঠাৎ সেখান থেকে খুব কাছেই এক অপূর্ব সুন্দর বৌদ্ধমন্দিরের চূড়া চোখে পড়ল। হাতে অনেক সময়। তাই সেই মন্দিরের প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়লাম।
সিহানুক রোডের সেই ওয়াত লঙ্কা মন্দিরে প্রবেশ করতেই একটা গাছের নিচে কয়েকটা ফল কুড়িয়ে পেলাম। কমলা হলুদ রং, চকচকে খোসা, অনেকটা মাকুর মতো আকার। চাপ দিতেই কিছুটা নরম বোধ হলো। তার মানে, পাকা। ফলটি চিনতে মোটেই কষ্ট হলো না।
বছর দশেক আগে আসাদ গেটে হর্টিকালচার সেন্টারে ফলটি প্রথম দেখেছিলাম। মাঝারি আকারের বৃক্ষ, সেই গাছের ডালে পাতার ফাঁকে কয়েকটা ফল ধরে ছিল। তখন পর্যন্ত ফলটিকে ‘জামান ফল’ নামেই চিনতাম। সেই ফলের গোত্রটোত্র জানতাম না, ঠিকুজি বা নাম ছিল অজানা। শুনেছিলাম, কৃষিবিজ্ঞানী হাসানুজ্জামান এই ফলের চারা বিদেশ থেকে এনে এ দেশে লাগিয়েছিলেন। কেউ সেই ফলের নাম জানতেন না, এমনকি তিনিও সঠিক কোনো নাম বলতে না পারায় শেষে তাঁর নামের শেষাংশ থেকে ফলটির লোকনাম হয়ে যায় জামান ফল। পরবর্তী সময়ে এই ফলের প্রসারে অবদান রাখেন বিশিষ্ট উদ্যানতত্ত্ববিদ এস এম কামরুজ্জামান। তিনি ফলটির নাম বলেছিলেন ‘টিসা ফল’। পরে অবশ্য বইপত্রে টিসা ফল নামটি পাই।
নমপেনের ওয়াত লঙ্কা বৌদ্ধমন্দির প্রাঙ্গণের গাছটি অনেক বড়। তবে যখন জানলাম, মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৪২২ সালে, তখন মনে হলো, মন্দিরের বয়সের তুলনায় গাছের বয়স কিছুই নয়! চেনা ফল, তাই খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। এর আগে দেখলেও এমন পাকা টসটসে ফল কখনো হাতে পাইনি। টিপ দিতেই শাঁস বেরিয়ে পড়ল। শাঁসের রং অবিকল ডিমের কুসুমের মতো, স্বাদেও তেমনি, স্বাদটা মিষ্টি। ভেতরে সফেদার মতো বিচি। খেয়ে বেশ মজা পেলাম। ফলের ভেতরে এক থেকে ছয়টি বাদামি শক্ত বীজ থাকে। বীজ থেকে চারা হয়। তবে বীজের সজীবতা দ্রুত হারিয়ে যায় বলে পাকা ফল থেকে সংগ্রহ করা বীজ দ্রুত রোপণ করতে হয়।
দেশে ফিরে আসাদ গেটের নার্সারিতে গিয়ে গাছটার খোঁজ করি। যেখানে গাছটা ছিল, সেই জায়গায় একটি নতুন ভবন উঠেছে। কাজেই গাছটা উন্নয়নযজ্ঞের বলি হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। তার বদলে যে আরেকটা সেই ফলের গাছ লাগানো হবে, সে রকম কোনো আশাই দেখলাম না। ধরে নিয়েছিলাম, আর বোধ হয় তার দেখা এ দেশে পাব না।
কিন্তু আমার সেই আশঙ্কা সত্যি হয়নি! এ বছর এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামে কৃষি গবেষণাকেন্দ্রে গিয়ে সেখানকার ফলের বাগানে নানা রকম বিদেশি ফলের দেখা পেলাম। তার মধ্যেই পেলাম তরুণ এই ফলের গাছের দেখা, সঙ্গে ফলও। এই তিন স্থানে দেখা ফলগুলোর চেহারা মোটামুটি একই রকম, আকৃতিও মাকুর মতো, মাঝখানে ফোলা, দুই প্রান্ত সরু, খোসা মসৃণ, চকচকে। তবে দেশে দেখা টিসা ফলের চেয়ে কম্বোডিয়ায় দেখা ফল প্রায় দ্বিগুণ বড় ছিল।
জাতভেদে এই ফলের আকার বিভিন্ন রকম হয়। একটি ফলের ওজন সর্বোচ্চ ৪০০ গ্রাম হতে পারে। কিন্তু এ আকৃতি ছাড়াও এ বছর ২৩ আগস্ট সাভার ক্যান্টনমেন্টের কাছে ডিসি নার্সারিতে গিয়ে দেখলাম ডিম্বাকার টিসা ফল, সার্থক তার ‘এগ ফ্রুট’ নাম। আকৃতি কিছুটা লাটিমের মতো, কচি ডাবের মতোও বলা যায়। সেই গাছে ধরা ফলগুলো কাঁচা। নার্সারির মালিক দীপক চন্দ্র নাথ বললেন, ফলটার নাম এগ ফ্রুট, পাকা ফলের শাঁসও সেদ্ধ ডিমের মতো, পাকলে ফলের রং হবে হলুদ, শাঁস মিষ্টি, ঘ্রাণ কাস্টার্ডের মতো, পাকবে হেমন্তে। পাকলে গাছ থেকে ফল আপনা–আপনি পড়ে যায়। গাছে পাকা এই ঝরা ফলের স্বাদ হয় সবচেয়ে ভালো। জানালেন, গাছটি তিনি সংগ্রহ করেছেন বিদেশ থেকে, গাছটির বয়স প্রায় আট বছর। বছরে কয়েক দফায় ফল ধরে। ডিম ফলের জন্ম মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলে।
ডিম ফল ‘ওরফে’ জামান ফলের ইংরাজি নাম ক্যানিস্টেল বা টিসা। ফিলিপিনো নাম টিসা বা চেসা। ডিম ফলের গাছ চিরসবুজ বহুবর্ষজীবী বৃক্ষ প্রকৃতির, ৩০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে, গাছের গুঁড়ির ব্যাস ১ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। পাকা ফল থেকে বীজ বের করার পর দ্রুত তার সজীবতা হারিয়ে যায়। এ জন্য চারা তৈরি করতে গেলে দ্রুত বীজ রোপণ হয়। এতে বীজ রোপণের দুই সপ্তাহের মধ্যে চারা গজায়, সেই গাছের বয়স তিন থেকে চার বছর হলে ফল ধরে।
ডিম ফলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Pouteria campechiana ও পরিবার স্যাপোটেসি; অর্থাৎ এটি সফেদার ‘সহোদর’। বহুবর্ষী বৃক্ষপ্রকৃতির গাছ, গাছ খুব শক্ত, বাত্যারোধী, বালুময় ও অনুর্বর মাটিতেও জন্মে। বসতবাড়ি বাগানে লাগানোর উপযোগী গাছ। কাঠ নির্মাণকাজে ব্যবহার করা যায়। পাকা ফল সুস্বাদু ও খাওয়া যায়। পাকা ফলের শাঁস দিয়ে প্যানকেক, জ্যাম ও মার্মালেড বানানো যায়। গাছটি এ দেশে সুলভ নয়। এমনকি এ দেশের উদ্ভিদের তালিকাতেও গাছটিকে নথিভুক্ত করা হয়নি।
মৃত্যুঞ্জয় রায়: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক