সন্ধ্যার পরপর হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের বাংলোতে পৌঁছালাম। সারা দিন রেমা কালেঙ্গার পাহাড়ি বনে অনেক হেঁটেছি। শরীরটা খুব ক্লান্ত। রাতের খাবার খুব তাড়াতাড়িই খেয়ে নিলাম।
ঘুমাতে যাওয়ার আগেই সহকর্মী বললেন, তিনি বনের এক পথে ঢুকবেন লজ্জাবতী বানর দেখতে। আমিও আর লোভ সামলাতে পারলাম না। নিশাচর এই প্রাণী রাতের বেলা খাবার খোঁজে। তাই তাকে দেখতে হলে রাতেই বনে ঢুকতে হবে। একটি লাইট হাতে দুজন বেরিয়ে পড়লাম।
সাতছড়ির পুকুরপাড় হয়ে যে এক ঘণ্টার হাঁটাপথ আছে, সে পথে যাব বলে ঠিক করলাম। দুজনেই চুপচাপ হাঁটতে থাকলাম। প্রায় পুরোটা পথে ঘুরলাম কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ফেরার পথেও এই বানরের হদিস পেলাম না। বন থেকে বের হয়ে এবার বড় রাস্তায় হাঁটতে থাকলাম। একটি বহেড়াগাছের ডালে একটি প্রাণীর চোখ জ্বল জ্বল করতে দেখলাম। এটিই যে লজ্জাবতী বানর হবে, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। অবশেষে তার দেখা পেলাম।
লজ্জাবতী বানর দিনের বেলা বড় গাছের আড়ালে গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে। তাই তাকে খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। বিশ্বব্যাপী বিপন্ন প্রজাতির বানর এটি। এর সম্পর্কে আমাদের হাতে খুব বেশি তথ্য নেই। বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের প্রিয় দুজন গবেষক হাসান আল-রাজী ও মার্জান মারিয়া প্রাণীটি নিয়ে গবেষণা করছেন সাতছড়ি বনে। লজ্জাবতী বানর নিয়ে অনেক রহস্যের উন্মোচনও করেছেন তাঁরা।
বনটিতে ৩৪টি লজ্জাবতী বানর আছে বলে ধারণা করা হয়। এই বানর সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই খাবারের জন্য বেরিয়ে পড়ে। পুরো রাত তারা মূলত খাবার খোঁজে। রাতের আঁধারে সাধারণত তারা বিভিন্ন গাছের আঠা খায়। এ ছাড়া ফুলের মধু ও ছোট ছোট পোকামাকড়ও খেয়ে থাকে।
লজ্জাবতী বানর অন্যান্য স্তন্যপায়ীর মতো নিজের এলাকা দখলে রেখে জীবন যাপন করে। এরা মূলত কমবেশি ১ দশমিক ৭ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিচরণ করে এলাকা ধরে রাখার চেষ্টা করে। রাতের বেলা এরা এক গাছ থেকে অন্য গাছে ঘুরে বেড়ায়। পুরো রাতের প্রায় অর্ধেকটা সময়ই এরা ভ্রমণ করে। আর খাবার খেতে ব্যয় করে প্রায় ১৫ ভাগ সময়। এই বানর প্রজাতিটি বেঁচে থাকে মাত্র ১৫ বছর। বাচ্চা দেয় মাত্র সাত-আটটি।
লজ্জাবতী বানর নিয়ে অনেক কিছুই আমাদের কাছে অজানা। গত ২৪ বছরে গোটা পৃথিবী থেকে এই প্রাণীর প্রায় ৫০ ভাগ হারিয়ে গেছে। কেন হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণীটি? গবেষকদের ধারণা, প্রাণীটিকে অনেক বেশি শিকার করা হয়। মূলত কবিরাজি চিকিৎসায় এর শরীরের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো দেশে এর মাংস খাওয়াও হয়। আর সড়ক দুর্ঘটনায় অথবা বৈদ্যুতিক তারে মারা পড়ে অনেক লজ্জাবতী বানর।
সাতছড়িসহ সিলেটের বনগুলোর ভেতর দিয়ে অনেক রাস্তা তৈরি হয়েছে। এমনকি মহাসড়কও আছে। লজ্জাবতী বানর সাধারণত মাটিতে নামতে চায় না। তাই রাস্তা পার হওয়া তাদের জন্য খুব দুরূহ। এই সংকট দূর করার জন্য হাসান আল-রাজী ও মার্জান মারিয়া তৈরি করেছেন একধরনের সেতু। লজ্জাবতী বানরের কাছে এই সেতু হলো স্বপ্নের মতো।
মূলত দড়ি দিয়ে রাস্তার ওপর দিয়ে একটি গাছের সঙ্গে আরেকটি গাছের সংযোগ করা হয়েছে। আর এতেই লাভবান হয়েছে প্রাণীটি। লজ্জাবতীসহ প্রায় সাতটি স্তন্যপায়ী প্রাণী এই সেতু ব্যবহার করছে এখন। সেতুটিতে প্রাণী চলাচল দেখার জন্য লাগানো হয়েছে বিশেষ ধরনের ক্যামেরা। এ তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, লজ্জাবতী বানর গত এক বছরে প্রায় ৬৭ বার এ সেতু ব্যবহার করেছে রাস্তা পারাপারের জন্য, যা তাদের জীবনকে বড় হুমকির হাত থেকে রক্ষা করেছে।
এ রকম উদ্যোগ অন্য এলাকায় নেওয়া হলে এই বানরসহ অন্যান্য প্রাণীর টিকে থাকার সুবিধা হবে।
সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণী গবেষক