হাতির অভয়ারণ্যে খামার-বাগান

অবৈধভাবে বিদ্যুতের সংযোগ টেনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাণিজ্যিক খামার গড়ে তোলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এনভায়রনমেন্ট পিপল।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের চেইন্দা বিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করে চলছে বাণিজ্যিক খামার ও ফলের বাগান। খামারে প্রবেশের জন্য ফটক ও পাহাড় কেটে তৈরি যাতায়াতের রাস্তা। গত শুক্রবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির চাইন্দা খোন্দকারপাড়ার পশ্চিমের পাহাড়ে বন্য হাতির অভয়ারণ্য ধ্বংস করে চলছে মৎস্য, পোলট্রির খামার ও ফল-সবজির বাগানের কাজ। এক মাস ধরে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে পুকুর খনন, বাঁশের খুঁটি টেনে বিদ্যুতের সংযোগ, রাসায়নিক দ্রব্য ও আগুনে গাছপালা ধ্বংস এবং শ্রমিক দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে ফলের গাছপালা রোপণ, প্লট আকারে জায়গাজমি বেচাবিক্রি হলেও নীরব বন বিভাগ।

হাতির অবাধ বিচরণের অভয়ারণ্যে অবৈধভাবে বিদ্যুতের সংযোগ টেনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাণিজ্যিক খামার গড়ে তোলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপল। সরেজমিনে ঘুরে সংগঠনের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, এলাকাটি হাতির অবাধ বিচরণক্ষেত্র। হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান-সংলগ্ন ওই বনভূমিতে ১২৭ প্রজাতির পাখি, অসংখ্য জীববৈচিত্র্য ও বন্য প্রাণীর আবাসস্থল। সেখানে বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠলে জীববৈচিত্র্য ও বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংসের পাশাপাশি প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বিপন্ন হবে।

এলাকায় হাতি যেন আসতে না পারে, সে জন্য বৈদ্যুতিক ফাঁদ বসানো হয়েছে। ফাঁদের জন্য অনেক দূর থেকে লাইন টেনে বিদ্যুৎ আনা হয়। কিছুদিন ধরে দখল করা বনভূমি বিভিন্ন লোকজনের কাছে প্লট আকারে বিক্রি করে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।
নুরুল ইসলাম, স্থানীয় কৃষক

গত শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, ১০-১২ জন সেখানে জঙ্গল পরিষ্কার করছেন। সোহেল নামের এক শ্রমিক বলেন, ৭০ একরের মতো বনাঞ্চল দখল করে মৎস্য ও পোলট্রি খামার এবং ফল ও সবজির বাগান করা হচ্ছে। কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে টানা হয়েছে বিদ্যুতের সংযোগও।

রামু চেইন্দা থেকে ছোট-বড় কয়েকটি পাহাড় অতিক্রম করে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। দুর্গম পাহাড়ে অবকাঠামো নির্মিত হলেও সেখানে যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ। পথে পথে পাহারায় থাকেন অস্ত্রধারী লোকজন।

স্থানীয় লোকজন জানান, বন বিভাগের অসাধু কর্মচারীদের ম্যানেজ করে হাতির অভয়ারণ্যে কয়েক মাস ধরে গাছপালা উজাড় ও পুকুর খননের কাজ শুরু করেন স্থানীয় প্রভাবশালী আজিজুল হক। এক মাস ধরে আজিজুল হকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আবু তাহের ও সাইদুল আলমের নেতৃত্বে স্থানীয় আরও কয়েকজন প্রভাবশালী। এখন গাছপালা কেটে এবং রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে বিভিন্ন প্রজাতির ফলের চারা রোপণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৭০ একরের বেশি বনাঞ্চল উজাড় হয়েছে। স্থানীয় বন বিট কর্মকর্তা ও ভিলেজাররা ঘটনাস্থলে যাতায়াত করলেও উচ্ছেদের বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছেন।

খোন্দকারপাড়ার কৃষক কবির আহমদ জানান, সেখানে কয়েক মাস আগেও ঘন জঙ্গল ছিল। বন্য হাতির বিচরণ ছিল। এখন গাছপালা নেই। জঙ্গল পরিষ্কার করে খামার তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় কৃষক নুরুল ইসলাম বলেন, এলাকায় হাতি যেন আসতে না পারে, সে জন্য বৈদ্যুতিক ফাঁদ বসানো হয়েছে। ফাঁদের জন্য অনেক দূর থেকে লাইন টেনে বিদ্যুৎ আনা হয়। কিছুদিন ধরে দখল করা বনভূমি বিভিন্ন লোকজনের কাছে প্লট আকারে বিক্রি করে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।

‘ডিএফও স্যার অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন।’
শ্যামল কুমার ঘোষ, বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ

দখল করা জায়গায় ফল ও সবজির বাগান করছেন আবু তাহের নামের এক ব্যক্তি। বনাঞ্চলের ভেতরে ব্যক্তিগত বাগান সৃজন প্রসঙ্গে আবু তাহের বলেন, আজিজুল হকের কাছ থেকে জায়গাটি স্ট্যাম্পমূলে কিনে ফলের বাগান করছেন তিনি। ইতিমধ্যে সেখানে ৯০ হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে। এলাকাটি হাতিপ্রবণ, তাই বরইগাছের চারা বেশি রোপণ করা হচ্ছে। বন বিভাগের লোকজন নিয়মিত ঘটনাস্থলে এলেও কাজে বাধা দিচ্ছেন না। সবকিছুর দেখভালের (ম্যানেজ) দায়িত্বে আজিজুল হক।

আজিজুল হক বলেন, পাহাড়ি এসব জমি ‘ভিলেজার’ হিসেবে বন বিভাগ তাঁকে দিয়েছে। সেখানে পাহাড় নিধন ও গাছপালা কাটা হয়নি, শুধু জঙ্গল পরিষ্কার করে তাঁরা কয়েকজন মিলে বাগান করছেন। প্লট আকারে জমির বিক্রির অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করেও চাইন্দা বন বিট কর্মকর্তা ফছিউল আলমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি ফোন ধরেননি। অভিযোগ প্রসঙ্গে ফছিউল আলম স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, গাছপালা কেটে খামার তৈরির খবর পেয়ে তাঁর নেতৃত্বে বনকর্মীরা কয়েক দফায় ঘটনাস্থলে গেছেন। দেখতে পান, ফলের চারা রোপণ করা হচ্ছে। বিদ্যুতের সংযোগ টানতে দেখেন। তখন বনাঞ্চল উজাড় থেকে বিরত থাকতে দখলদারদের নিষেধ করেন। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অভিহিত করা হয়। কিন্তু সাড়া মিলছে না।

এ প্রসঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সরওয়ার আলমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনিও ফোন ধরেননি। একই বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শ্যামল কুমার ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিএফও স্যার অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন।’

হাতির অভয়ারণ্য দখল করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে মৎস্য খামার, পোলট্রি ও ফলের বাগান সৃজন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্যামল কুমার ঘোষ উল্টো জানতে চান, এসব কোথায় হচ্ছে? কবেকার ঘটনা? প্রতিবেদক জায়গা ও দখলদারের নাম জানালে খবর নিয়ে জানাচ্ছি বলে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন তিনি।

সদর বন রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমির রঞ্জন সাহা বলেন, হাতির অভয়ারণ্য উজাড় করে মৎস্য ও পোলট্রি তৈরির খবর জানা নেই। খোঁজ নিয়ে জানাবেন বলে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।