সুন্দরবনে আগুনের জন্য মাছ ব্যবসায়ী ও অসৎ বনকর্মীরা দায়ী: বাপা

সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে বাপা আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী। আজ মঙ্গলবার সকালে ডিআরইউএর সাগর–রুনি মিলনায়তনেছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবন রক্ষায় বন বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, বেসরকারি সংস্থা, বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজনদের নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করার দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবিষয়ক সংগঠন বাপার নেতারা। তাঁরা বলেছেন, কিছু মুনাফালোভী মাছ ব্যবসায়ী ও বন বিভাগের অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজশে পরিকল্পিতভাবে বারবার সুন্দরবনে আগুন লাগানো হচ্ছে। সুন্দরবন অস্তিত্বের হুমকিতে পড়েছে। বন বিভাগকেই এর দায় নিতে হবে।
আজ বুধবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘বারংবার আগুন–সন্ত্রাসের কবলে সুন্দরবন: কারণ ও প্রতিকার’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সহসভাপতি মহিদুল হক খান সভাপতিত্ব করেন। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুন্দরবনবিশেষজ্ঞ ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী।

মূল বক্তব্যে বলা হয়, গত ২২ বছরে সুন্দরবনে ৩২ বার আগুন লেগেছে। এতে শতাধিক একর বনভূমি পুড়ে গেছে। সর্বশেষ ৪ মে বনের পূর্ব পাশের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে। বন বিভাগের হিসাবেই ৭ দশমিক ৯ একর বনভূমি পুড়ে যায়। লক্ষণীয় বিষয়, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জের মধ্যে কেবল পূর্ব দিকের চাঁদপাই ও শরণখোলা—এই দুটি রেঞ্জেই অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। পশ্চিমের সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জে অগ্নিকাণ্ড ঘটেনি। প্রকৃতপক্ষে এ দুটি রেঞ্জ তুলনামূলকভাবে উঁচু এবং নদী–খাল খনন করে সেই মাটি পাড়ে ফেলে রাখা হয়েছে। ফলে জোয়ারের সময় অন্য এলাকার তুলনায় এখানে পানির প্রবেশ কমে যায়। কোথাও কোথাও পানি প্রবেশই করতে পারে না। ফলে গাছ থেকে ঝরে যাওয়া পাতা শুকনা থাকে। আগুন জ্বলতে সুবিধা হয়।

আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী আরও বলেন, অগ্নিকাণ্ড ঘটে সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে, বর্ষার আগের দিকে। এই অঞ্চলে পানিতে লবণাক্ততা তুলনামূলক কম থাকায় এখানে কই, মাগুর, শিং, টাকি—এ ধরনের জিওল মাছের পরিমাণ বেশি থাকে। প্রাক্‌–বর্ষায় আকাশে মেঘের ডাকাডাকি শুরু হলে এই মাছগুলো খানিকটা শুকিয়ে আসা এলাকায় উঠে আসে। তখন এখানে জাল পেতে প্রচুর মাছ ধরা হয়। মাছ ব্যবসায়ীরা এসব এলাকা ইজারা নিয়ে থাকে। এ কারণেই জাল পাতার সুবিধার্থে তারা আগুন জ্বালিয়ে বেশ বড় এলাকার গাছপালা, শ্বাসমূল পুড়িয়ে ফেলে। এ কাজে লোভী মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বন বিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী যুক্ত থাকার অভিযোগ অনেক দিন থেকেই রয়েছে। বন বিভাগের একাধিক তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু নেপথ্যে থাকা মাছ ব্যবসায়ী বা বন বিভাগের দোষী লোকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে এই চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের আগুন–সন্ত্রাসের কবলে পড়ে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়েছে।

২০২১ সালে সুন্দরবনের দাসের ভারানি এলাকায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে
ফাইল ছবি

এবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সরেজমিন তদন্ত করেছেন বাপার কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক নূর আলম শেখ। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বন বিভাগ কখনোই অগ্নিকাণ্ডের খবর প্রথমে পায় না। তাদের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকেই দেখা গেছে, আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল ৩০ এপ্রিল। স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের জানালেও তারা আমলে নেয়নি। গণমাধ্যমে ৪ মে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পরপর তারা আগুন নেভানোর উদ্যোগ নেয়। দ্রুত ব্যবস্থা নিলে ক্ষতি কম হতো। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রেই এমন বিষয় দেখা গেছে। পরে বন বিভাগ নিজেদের লোক নিয়েই তদন্ত কমিটি গঠন করে। তারা গৎবাঁধা কিছু কারণ উল্লেখ করে। কিন্তু দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হয় না। বৈজ্ঞানিকভাবে সুন্দরবনে দাবানল সৃষ্টির কারণ নেই। কারণ, এখানে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকে। উপরন্তু মাটিতে পড়া পাতা জোয়ারের পানিতে ভেজা বা পচা থাকে। লবণাক্ততাও রয়েছে। ফলে সুন্দরবনে দাবানলের সুযোগ নেই।

সংবাদ সম্মেলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল কাদের বলেন, তাঁরা সুন্দরবনে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যৌথভাবে একটি গবেষণা করেছেন। সেখানে তাঁরা দেখতে পেয়েছেন, ১৯৭৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে মাত্র ১৩ শতাংশ ঘন বন টিকে আছে। বাকি ৮৭ শতাংশ বন এলাকার গাছপালা নানাভাবে পরিবর্তিত হয়ে বন ঘনত্ব হারিয়েছে।
বাপার যুগ্ম সম্পাদক ড. আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘সুন্দরবনে পানি, মাটি, বায়ু—সব ধরনের দূষণ বেড়েছে। এখানে ইকোট্যুরিজমের নামে লাগামহীনভাবে স্থাপনা তৈরি হচ্ছে, ভেতরে অবাধে নৌযান চলাচল করেছে। “নীরবতা” ছিল এই বনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এখন তা হারিয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবনে ক্রমেই শব্দদূষণ বাড়ছে। সুন্দরবনকে অপরিমিত লোভ ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে যে বন আমাদের রক্ষা করছে, সেই বনকে আমরা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছি।’

সুন্দরবনে লাগা আগুন নেভানোর কাজ চলছে
ফাইল ছবি

সংবাদ সম্মেলনে সুন্দরবন রক্ষায় ১৫টি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বন রক্ষায় সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় কমিটি গঠন। তদন্ত কমিটিতে শুধু বন বিভাগের লোকজন না রেখে ফায়ার ব্রিগেড, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সুন্দরবনবিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে সমন্বিত তদন্ত কমিটি গঠন করা। বনের ভেতরে অবাধে চলাচল নিষিদ্ধ করা। অপরিকল্পিতভাবে খাল খনন বন্ধ করা এবং খনন করা মাটি খালের পাড়ে ফেলা বন্ধ করা।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী প্রধান জাকির হোসেন, সঞ্চালনা করেন বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির।