গোল্ডফিঞ্চের গান

ইউরোপীয় গোল্ডফিঞ্চ, জার্মানির গ্রেটস্টাড থেকে
ছবি: লেখক

গম ও রাই শর্ষের খেতের মধ্য দিয়ে চলে গেছে লম্বা একটি পথ। পথের এক পাশ বৃক্ষ, গুল্ম ও ঘাসে আচ্ছাদিত। ফার্মল্যান্ড বার্ডদের (আবাদি জমিতে বিচরণকারী পাখি) জন্য জার্মানির প্রতিটি এলাকার আবাদি জমির মাঝে লম্বা সারিতে দেশি প্রজাতির গাছপালা রোপণ করা হয়। একে বলা হয় হেজরো প্ল্যানটেশন। পাখিরা যেন ভূমিতে খাবার খেয়ে নিরিবিলি বিশ্রাম নিতে পারে, বাসা বানাতে পারে ও লুকিয়ে থাকতে পারে, এ জন্যই এ ধরনের বৃক্ষ রোপণ করা হয়।

সকালে রোদ পোহাতে ডানা মেলে দুটি ছোট পাখি উড়ে এসে বসেছে হেজরোর পাতাহীন একটি গাছের ডালে। হালকা স্বরে পাখি দুটি গান গাইছে। গানের সুর মেলোডিক, টিঙ্কলিং...টিঙ্কলিং...টিলিট...টিলিট শুনতে এ রকম লাগে। কিছুক্ষণ পরে এ পাখির আরও একটি ছোট ঝাঁক উড়ে এল সেই গাছটিতে। দূর থেকে বাইনোকুলার দিয়ে তাদের আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করছিলাম। একটু থেমে থেমেই তারা গান ধরে। খানিক বাদেই দুটি পাখি উড়ে গিয়ে বসল রাই শর্ষের ডালে। রাই শর্ষের ফল ইতিমধ্যে পরিপক্ব হয়েছে। পাখি দুটি তাদের ঠোঁট দিয়ে ফলের বহিঃত্বক কেটে বীজ খাওয়া শুরু করল। গাছের ডালে থাকা অন্য ঝাঁকটিও এর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে রাই শর্ষের খেতে। দীর্ঘ রাতের পরে সকালে পাখিরা খাবার খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পাখি দুটির নাম গোল্ডফিঞ্চ। তারা শর্ষের বীজ খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। খাবার খাওয়ার মাঝে মৃদু সুরে গান করছিল আর চলছিল নানা ধরনের খুনসুটি। সেটাই তাদের প্রেম ও ভালোবাসা। কদিন পরেই তারা বাসা বানাবে।

হঠাৎ উড়ে এল একটি বাজপাখি। ছোট পাখিগুলো দ্রুত উড়ে গিয়ে পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। কারও খুঁজে পাওয়ার সাধ্য নেই। জার্মানিতে অনেক প্রজাতির ফিঞ্চ রয়েছে। যেমন গোল্ডফিঞ্চ, গ্রিনফিঞ্চ, চ্যাফফিঞ্চ, বুলফিঞ্চ, রোসফিঞ্চ ইত্যাদি। প্রতিটি প্রজাতির রংই সুন্দর। তবে গোল্ডফিঞ্চ একটু আলাদা এবং সবার কাছে আকর্ষণীয় তাদের পালকে বিচিত্র রঙের জন্য। বিশেষ করে ডানায় উজ্জ্বল হলুদ এবং ঠোঁট ও চোখের চারদিকে যেন লাল পালকের মুখোশ। এদের চলাফেরা বেশ স্মার্ট ও পরিপাটি। একটি ঝাঁকে ১০ থেকে ৪০টি পাখি থাকে। কখনো কখনো আরও বেশি। প্রজনন মৌসুম ছাড়া দলে চলে।

সাধারণত ঘাসবনের কাছে বড় বৃক্ষের ঝোপে এরা সময় কাটায়। কিন্তু প্রজনন মৌসুমে জোড়ায় জোড়ায় চলে। ছোট থেকে মাঝারি দূরত্বে উড়ে বেড়ায়। একই গাছে প্রায়ই উড়ে আসে। পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছে, এরা প্রজননের সময় তাদের নির্দিষ্ট বাছাই করা এলাকাতেই থাকতে পছন্দ করে। শরৎকালে ছানা ও প্রাপ্তবয়স্করা একসঙ্গে থাকে। ইউরোপীয় গোল্ডফিঞ্চের বৈজ্ঞানিক নাম Carduelis carduelis। এরা ইউরোপের আদিবাসী। অতিরিক্ত শীতের সময়ে উষ্ণ এলাকায় পরিযায়ন করে। সুন্দর বর্ণের জন্য উনিশ শতকে ইউরোপ থেকে এদের কানাডা, আমেরিকা, মেক্সিকো, পেরু, আর্জেন্টিনা, চিলি, নিউজিল্যান্ডসহ নানান দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। ছেড়ে দেওয়া হয় প্রকৃতিতে। এসব দেশে তারা খাপ খেয়ে গেছে। মূলত শস্য ও ঘাসের বীজ খায়, যে কারণে অন্য মহাদেশে তাদের অভিযোজিত হতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। এ পাখির জার্মান নাম স্টেগ্লিৎজ।

জার্মানির বার্লিনের একটি গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে এ পাখির নামে। ১৫১৫ সালে সুইস প্রকৃতিবিদ কনরাড গেসনার তাঁর বই হিস্টোরিয়া এনিমিয়াতে সুন্দর এই পাখির প্রথম বর্ণনা ও চিত্রায়ণ করেন।