নতুন ফুল হলুদ জেসমিন
জেসমিন নামটা শুনতেই উত্তর আফ্রিকার একটা কিংবদন্তির কথা মনে পড়ল। এক মরুভূমিতে বাস করত এক তরুণী। সে ছিল অপরূপ সুন্দরী। মরুভূমির তাপ থেকে নিজের রূপকে রক্ষা করতে সব সময় সে বেশ কটি ওড়না দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখত। সূর্যও তার মুখ দেখতে পেত না।
কেবল চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হতো তার মুখমণ্ডল। তা দেখে চাঁদও লজ্জা পেত। কিন্তু কী করে যেন সে দেশের যুবরাজের কাছে তার এই রূপের কথা পৌঁছে গেল। যুবরাজ সেই সুন্দরীকে দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠল।
একদিন সন্ধ্যায় ঘোড়ায় চড়ে বালু আর পাহাড় ডিঙিয়ে যুবরাজ চলে গেল সেই মরুভূমিতে। তাকে দেখে সে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়ে গেল। জেসমিনকে সে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে–ও তাতে সম্মতি দিল। যুবরাজ তাকে তার প্রাসাদে নিয়ে এল। প্রাসাদে এসে জেসমিন দেখল, সে তার স্বাধীনতা হারিয়েছে। তার ব্যাপারটা ভালো লাগল না।
তাই এক রাতে চুপিসারে ঘোড়ায় চড়ে আবার সে তার মাতৃভূমি সেই মরুভূমিতে ফিরে এল। ফিরে এলেও সে জানত যে যুবরাজ ঠিকই আবার তাকে খুঁজতে সেখানে আসবে এবং তাকে আবারও রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাবে। তাই ফিরে এসে সে তার সব ওড়না সরিয়ে সূর্যের কাছে দুই হাত তুলে আত্মরক্ষার জন্য সে মিনতি জানাল। সূর্যদেব তখন তাকে পাঁচ পাপড়ির একটি সুন্দর ফুলে পরিণত করে দিলেন, যার মৃদু সুবাস ও সৌন্দর্য হয়ে রইল শাশ্বত প্রেমের প্রতীক হয়ে।
সেই থেকে জেসমিন হয়ে রইল একটি ফুল, মানুষের কাছে প্রিয় জুঁই বা যূথিকা। এই কিংবদন্তির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সৌন্দর্য, প্রেম, আশা, স্বাধীনতা ও মাতৃভূমির প্রতি টান। ভারতে জুঁই ফুলকে মনে করা হয় সুখ, আশা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক।
জেসমিন নামটা আমাদের খুব পরিচিত। জুঁই ফুলের ইংরেজি নামও জেসমিন। এ ফুলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামের গণও জেসমিন। কিন্তু এ বছর জানুয়ারির ১২ তারিখে সাভারে ডিসি নার্সারিতে গিয়ে দেখলাম ইয়েলো জেসমিনকে। এই ইয়েলো জেসমিন বা হলুদ জেসমিন আমার কাছে পরিচিত না। এর সঙ্গে জুঁইয়ের কোনো মিলই নেই। কিন্তু নামটা জেসমিন। ফুলগুলোও জুঁই ফুলের মতো সাদা না, হলুদ ও ঘণ্টাকৃতি। ফিরে এসে বইপত্র ঘাঁটা শুরু করি। এ নামে দেশের উদ্ভিদ তালিকায় কোনো ফুল পেলাম না। তার মানে ফুলটা নতুন এসেছে এ দেশে, এখনো দেশের তালিকায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ডিসি নার্সারির দীপক নাথ জানালেন, তিনি কয়েক মাস আগে এর প্রায় এক শ চারা এনেছেন থাইল্যান্ড থেকে। গাছগুলোতে বেশ ফুল ফুটছে। লতানো স্বভাবের গাছ। বাগানে বা বাড়িতে লাগালে বোঝা যাবে, কেমন রূপ খোলে এ গাছের।
নতুন ফুল ইয়েলো জেসমিন। তাই এর কোনো বাংলা বা স্থানীয় নামও নেই। ফেসবুকে সেদিন ফুলটার ছবি দিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম এর পরিচয় জানতে। খুলনা থেকে প্রকৃতপ্রাণা ডা. শেখ আবদুল্লাহ আল মামুন সে ফুলটার একটা লিংক পাঠিয়ে লিখেছিলেন, ‘দাদা, ধারণা করি লিংকটা আপনার কাজে লাগবে।’ সেই সূত্র ধরেই ইয়েলো জেসমিনের পরিচয় জেনেছিলাম। তার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Gelsemium sempervirens ও গোত্র Gelsemiaceae। এটি আমেরিকার স্থানীয় গাছ হলেও সে এখন ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য দেশে। আমেরিকার সাউথ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের রাষ্ট্রীয় ফুলও এটি।
এ গাছ লতানো স্বভাবের, গাছ তিন থেকে ছয় মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। চিরসবুজ এ গাছ বাঁচে অনেক বছর। চিরসবুজ হলেও শীতে এর পাতাগুলো শীর্ণ ও লালচে সবুজ হয়ে যায়। পাতা দেখতে অনেকটা জেসমিন বা জুঁই ফুলগাছের পাতার মতো, পাতা ২-১০ সেন্টিমিটার লম্বা, গাঢ় সবুজ। থোকায় কয়েকটা ফুল ফোটে। ফুলের মাঝখানে কখনো কখনো কমলা রঙের ছোপ থাকে, প্রচুর ফোটে।
ফুলে ঘ্রাণ আছে, মৌমাছিরা এ ফুলের রূপে আকৃষ্ট হয়ে মধু খেতে আসে। তবে সেটি তাদের জন্য যেন মরণফাঁদ। এ ফুলের মধু মৌমাছি ও মধুচুষি পাখির জন্য ক্ষতিকর, বিষাক্ত। এমনকি গবাদিপশুর জন্যও এ গাছ বিষাক্ত। এ গাছের কষ বা রস ত্বকে লাগলে সেখানে চুলকায়। প্রখর রোদের চেয়ে হালকা ছায়া জায়গায় এ গাছ ভালো হয়।
দেশের কোথাও হলুদ জেসমিন আছে বলে আর কেউ জানাননি। তাই ফুলটাকে নতুন বলেই মেনে নিয়েছি। এভাবে বহু গাছ অতীতে বিদেশ থেকে এসে আমাদের দেশে ঠাঁই করে নিয়েছে। মরিচ, লিচু, পেঁপে, গাঁদা—এসব গাছকে আজ আমাদের যতটা আপন মনে হয়, ওরা কেউই আমাদের দেশের গাছ না।
বিভিন্ন সময়ে নানা বিদেশির হাত ধরে এখানে এসেছে। এসে এ দেশের জল-মাটি ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে ধীরে ধীরে আমাদের আত্মীয় হয়ে উঠেছে। তেমনি ইয়েলো জেসমিনও আজ বিদেশি নবাগত থাকলেও, হয়তো একদিন সে এ দেশের উদ্ভিদসম্পদকে সমৃদ্ধ করবে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক