ঝড়ে কুড়িয়ে পাওয়া ছানা

লক্ষ্মীপেঁচার এই বাচ্চাটি গত ৬ এপ্রিল ঢাকা থেকে উদ্ধার করা হয়
ছবি: মহসীন ইমরান

বৈশাখ শুরুর আগে আগেই ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। ৭ এপ্রিল পাখিবন্ধু মহসীন ইমরান ফোন দিয়ে জানালেন, তাঁর অফিসের পাশে একটি লক্ষ্মীপ্যাঁচার বাচ্চা পাওয়া গেছে। বাচ্চাটি একটি পায়ে আঘাত পেয়েছে। এখন উপায় কি! বললাম, ছাদের ওপর একটি নিরাপদ জায়গায় রেখে দিতে। রাতে মা–বাবা আশপাশে থাকলে তার আওয়াজে ফিরে আসতে পারে। পায়ে একটু ওষুধ লাগিয়ে হালকা খাবার দেওয়া হলো ছানাটিকে। সুস্থ হলে রেখে আসা হলো ছাদের এক কিনারে। হয়তো বাচ্চাটি তার মা–বাবার কাছে ফিরে গেছে। শুধু লক্ষ্মীপ্যাঁচা নয়, এ রকম ঘটনা এখন বিভিন্ন পাখি প্রজাতির বেলায় ঘটছে। বিশেষ করে যারা গ্রীষ্মে বাসা বানায় ও বাচ্চা ফোটায়। এ দেশের বেশির ভাগ আবাসিক পাখিই এই মৌসুমে প্রজননকাল সম্পন্ন করে।

এ বছরের মার্চ মাসের আরেকটি ঘটনা। হাওরে বড় ঝড় হলো। টাঙ্গুয়ার হাওরের শুকাইর নামের একটি জায়গাতে কুড়া ইগলের বাসা ভেঙে গেছে। গাছের মালিক আমাদের ফোন দিল। দুটি বাচ্চাই আহত হয়েছে। মা পাখিটি নড়াচড়া করতে পারছে না। পাখিটিকে তিন দিন চিকিৎসার পর উড়ে যেতে পারল। একই দিনে কামালপুরে বাসাসহ গাছটিই ভেঙে গেল আর মারা পড়ল দুটি বাচ্চা। ২০২২ সালের ১৪ এপ্রিলের আরেকটি ঘটনা। প্রচণ্ড ঝড় আঘাত হানল  টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায়। আমরা একটি কুড়া ইগলকে মঙ্গোলিয়ার বুটসাগান লেকে স্যাটেলাইট ট্যাগ করেছিলাম। সেটি বাসা বেঁধে বাচ্চা ফুটিয়েছিল জামালগঞ্জ এলাকায়। পাখিটির নাম দিয়েছিলাম আরাঙ্গা। সেদিন ঝড়ের পরে পাখিটিকে আমরা অর্ধমৃত অবস্থায় একটি ধানখেত থেকে উদ্ধার করি। তারও দুটি বাচ্চার মধ্যে একটি বাচ্চাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। কিছুদিন পর আরাঙ্গাও মারা যায়।

শকুনের বাচ্চাটি হবিগঞ্জের রেমা বন থেকে গত ১ এপ্রিল উদ্ধার করে সুস্থ করে তোলা হয়
ছবি: বিপ্লব মিয়া

গত পাঁচ বছর ধরে হাওর এলাকার কুড়া ইগলের বেশ কিছু বাসার নিয়ে আমরা গবেষণা করছি। আর প্রতি মৌসুমেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রায় অর্ধেক বাসা ধ্বংস হচ্ছে ঝড়ে। বিপন্ন এই পাখিটির এখন বড় শত্রু হলো মৌসুমি ঝড়। গত এক দশকে ঝড়ের তীব্রতা এতই বেড়েছে যে এই পাখি প্রজাতিটি এখন গাছে বাসা বানানোর চেয়ে মোবাইল টাওয়ারে বাসা বানাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। আর টাওয়ার কোম্পানিগুলো এই বাসাগুলোও আবার পরিষ্কার করছে।

ঝড়ের তাণ্ডবে অনেক প্রজাতির বাসা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শকুনের বাসা কখনো ভাঙতে দেখিনি। এ বছর এপ্রিলের প্রথম দিনেই শকুনের বাসাও ভাঙতে দেখলাম। প্রথম ঝড়েই হবিগঞ্জের রেমা বনে একটি শকুনের বাসা সম্পূর্ণ ভেঙে গেল। বাসায় থাকা ছানাটি মাটিতে পড়ে গেলে। এ বছর পুরো এলাকায় মাত্র দশটি বাসা ছিল। আমরা অন্তত ছয়টি বাচ্চা পাওয়ার আশা করছিলাম। কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাটিকে খাঁচার ভেতর রাখলাম। চিকিৎসা আর খাবারের ফলে বাচ্চাটি সুস্থ হয়ে উঠল।

আরাঙ্গা নামের এই পালাসের কুড়া ইগল ও তার বাচ্চাকে ২০২২ সালের ১৪ এপ্রিল উদ্ধার করা হয়।
ছবি: সাকিব আহমেদ

মৌসুমের ঝড়ের শুরুতেই এসব জানা গল্প। এ রকম শত শত অজানা গল্প আমাদের অগোচরে ঘটছে। পাখির ছানা কুড়িয়ে পেলে আমরা ছোট ছেলে-মেয়েদের খেলার উপসঙ্গী হিসেবে তুলে দিই। কেউ আমরা পাখিগুলো দুঃখ-দুর্দশার কথা ভাবি না। অথবা এসব আমাদের জন্মগতভাবেই শেখানো হয় না। জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হয়তো ডালপালার শক্ত হওয়ার অভিযোজন ক্ষমতা তৈরি হয়নি। পাখিদেরও তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি হয়নি যে তারা যেভাবে বাসা বানাত তার চেয়ে শক্ত কোটরে বাসা তৈরি করতে হবে। আবহাওয়ার এত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে যে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রাণীরাও টের পাচ্ছে জীবন বাঁচাতে কী করতে হবে।

ঝড়ের পরে আপনার চারপাশে পাখির ছানা কুড়িয়ে পাবেন। প্রায় প্রতিদিনই এ রকম ঘটনা এখন ঘটবে। যতটা সম্ভব তাদের চিকিৎসা আর খাবার দিয়ে নিরাপদ জায়গায় ছেড়ে দিন। আর এর দায়িত্ব সাধারণ মানুষকেই নিতে হবে। কারণ, আমাদের মতো এত জনবহুল একটি দেশে প্রাণী উদ্ধারের জন্য সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। দুর্যোগ নিয়ে যা কাজ হয়, তা সবই মানুষের জন্য। তাই সবার চেষ্টায় আমরাই পারি পাখিগুলোকে তার আপন ঠিকানায় ফিরিয়ে দিতে।

লেখক: বন্য প্রাণী গবেষক