সিত্রাংয়ের পূর্বাভাসের গরমিল নিয়ে প্রশ্ন

সিত্রাংয়ের প্রভাবে বিঘাই নদের জোয়ারে ডুবে গেছে তীরবর্তী এলাকাসহ আশপাশের গ্রাম–সড়ক। সন্তানকে নিয়ে নাসিমা বেগম গিয়েছিলেন তাঁর বাবার বাড়ি বেড়াতে। কিন্তু পানি বেড়ে বাড়ি ডুবে যাওয়ার আতঙ্কে শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাচ্ছেন তিনি। গত সোমবার বিকেল পৌনে চারটা, দাড়িয়াল গ্রাম, বাকেরগঞ্জ, বরিশালছবি: সাইয়ান

আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে গত সোমবার রাত ১০টায় একটি বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, ‘ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং রাত নয়টায় ভোলার কাছ দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে। তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে এটি উপকূল অতিক্রম করতে পারে।’

ওই দিন সাড়ে তিন ঘণ্টা আগে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার বুলেটিনে বলা হয়েছিল, ‘ঘূর্ণিঝড়টি আজ (সোমবার) মধ্যরাত/আগামীকাল ভোর নাগাদ ভোলার কাছ দিয়ে অতিক্রম শুরু করতে পারে।’ সাড়ে তিন ঘণ্টার ব্যবধানে আবহাওয়ার এমন পূর্বাভাস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বাংলাদেশের উপকূলের কোন অঞ্চল দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি ঢুকবে, সেটি নিয়েও বিভ্রান্তি ছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বেলা দুইটার বুলেটিনে বলা হয়েছিল, ‘ঘূর্ণিঝড়টি পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে।’ সাড়ে চার ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার বুলেটিনে বলা হয়, ‘এটি ভোলার কাছ দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম শুরু করতে পারে।’

‘সিত্রাং আঘাত হানার সময় নিয়ে বিভ্রান্তি ও পূর্বাভাস না মেলার বিষয়ে আমি আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, আবহাওয়াবিদ্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়ার আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে জনবল কম আছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে এমন ভুল থেকে আরও বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে।’
এ এস এম মাকসুদ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য এবং দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক
আরও পড়ুন

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের মতো দুর্যোগের পূর্বাভাস যতটা সম্ভব নির্ভুল ও যথাসময়ে দেওয়া উচিত। কোন এলাকায় আঘাত হানতে পারে, সেটিও সঠিকভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। এতে ওই অঞ্চলের মানুষ নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার পর্যাপ্ত সময় পাবেন। এর আগে সিডর, আইলা, ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনেকটাই সঠিক ছিল।

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর প্রভাবে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় বাঁধগুলো ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। ছবিটি সোমবার খুলনার কয়রা উপজেলার হরিণখোলা এলাকায় তোলা
ছবি: প্রথম আলো

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য এবং দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিত্রাং আঘাত হানার সময় নিয়ে বিভ্রান্তি ও পূর্বাভাস না মেলার বিষয়ে আমি আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, আবহাওয়াবিদ্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়ার আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে জনবল কম আছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে এমন ভুল থেকে আরও বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে।’

শুরু থেকেই ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের পূর্বাভাস নিয়ে দোলাচলে ছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর গত শনিবার থেকে বলে আসছিল, ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তিনকোনা দ্বীপ এবং বাংলাদেশের বরিশাল ও সন্দ্বীপ উপকূলে আঘাত করবে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভূ-উপগ্রহ জুম আর্থের পূর্বাভাসও ঝড়ের সম্ভাব্য গতিপথ ভোলা-বরিশালের দিকে বলে উল্লেখ করেছিল।

‘সিত্রাং বেশ অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। বারবার গতিপথ বদলানোর কারণে এটি কোথায় আঘাত করবে, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না।
আবদুল মান্নান, আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ
আরও পড়ুন

তবে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর, যুক্তরাষ্ট্রের জুম আর্থসহ অন্যান্য সংস্থা মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে সকালের মধ্যে সিত্রাং আঘাত করতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। এসব পূর্বাভাস, বিশেষ করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রায় সব পূর্বাভাসকে ভুল প্রমাণ করে সোমবার রাত নয়টায় বাংলাদেশে আঘাত করে। আর সন্ধ্যা ছয়টায় ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ বাংলাদেশের উপকূলে পৌঁছায়।

সিত্রাং এর প্রভাবে সৃষ্ট আবহাওয়া পরিস্থিতি নিয়ে মাইকিং করছেন কোস্ট গার্ডের সদস্যরা। গত সোমবার বরিশাল নগরের ডিসি ঘাট এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

কেন এমন হলো, জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিত্রাং বেশ অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। বারবার গতিপথ বদলানোর কারণে এটি কোথায় আঘাত করবে, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। আর রাত নয়টায় ভোলায় আঘাত হানার পর আবহাওয়া অধিদপ্তর বুঝতে পারলেও বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ ব্যাহত হওয়ায় তা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে তুলতে দেরি হয়ে যায়।

তবে ঘূর্ণিঝড় আদৌ রাত নয়টায় নাকি তারও আগে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হেনেছে, তা নিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কারণ, আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বেশি বাতাস রেকর্ড করা হয়েছে গোপালগঞ্জে রাত দুইটায়। ওই সময় সেখানে ঘণ্টায় ৭৫ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে যায়। অন্যদিকে বিকেল ৪টায় কক্সবাজারে ৭৪ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে গেছে। চট্টগ্রামেও রাত ৯টায় ৭৪ কিলোমিটার ও ঢাকায় রাত পৌনে ৯টায় ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে গেছে।

প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে। সিত্রাংয়েরও আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। তবে এটি ছিল বেশ এলোমেলো।
মো. বজলুর রশীদ, আবহাওয়াবিদ

অতীতে বাতাসের সবচেয়ে বেশি গতিবেগ পাওয়া গেছে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রীয় অংশের আশপাশের এলাকায়। যেমন ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের অগ্রভাগ আঘাত করার সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ১২০ থেকে ১৪০ কিলোমিটার। আর কেন্দ্রীয় অংশটি উপকূল অতিক্রমের সময় বাতাসের গতিবেগ ২০০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়।

আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে। সিত্রাংয়েরও আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। তবে এটি ছিল বেশ এলোমেলো।

বজলুর রশীদের মতে, ঘূর্ণিঝড়ের রূপ ধারণের আগে নিম্নচাপের সময়ই এটি তিন অংশে ভাগ হয়ে যায়। বারবার পাল্টেছে গতিপথ। প্রথমে ভারতের ওডিশা, পরে পশ্চিমবঙ্গ এবং শেষে বাংলাদেশের উপকূলমুখী হয়েছে। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরও গতকাল পর্যন্ত একে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বলেছে। কিন্তু আসার পথে এটি প্রবল বৃষ্টি ঝরায় বলে শক্তি ক্ষয় হয়। তাই এটি দ্রুত এসে দ্রুত চলে যায়।