মহাবিপন্ন হয়ে গেল সুন্দরী হাঁস

কালামুখ প্যারাপাখি বা সুন্দরী হাঁস। গত বছরের ১২ মে সুন্দরবনের একটি খালে
ছবি: লেখক

সুন্দরবন ভ্রমণে পর্যটকদের প্রায় সবারই বাঘ দেখার আশা থাকে। বাঘের দেখা যাঁরা পান, তাঁরা মহাভাগ্যবান। বাঘের উপস্থিতি সুন্দরবনকে বিশ্বদরবারে অন্য রকম এক মর্যাদা দিয়েছে। আর সঙ্গে এই বনকেও দিয়েছে সুরক্ষা।

তবে বাঘের চেয়েও বিরল একটি প্রাণী সুন্দরবনে আছে, যেটির খবর প্রায় কেউই আমরা রাখি না, সেটি একটি পাখি। এই পাখির নাম কালামুখ প্যারাপাখি। তবে সুন্দরী হাঁস নামেই সাধারণ মানুষ চেনেন। গত বছর এই পাখি আইইউসিএনের লাল তালিকায় বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন পাখি হিসেবে স্থান পেয়েছে। তার মানে পাখিটি প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার শেষ ধাপে আছে।

কালামুখ প্যারাপাখির ইংরেজি নাম মাসকড ফিনফুট। সুন্দরবনের বাইরে পাখিটির উপস্থিতি তেমন নেই। সম্প্রতি প্রকাশিত এক বিজ্ঞান প্রবন্ধে দেখা যায়, সারা পৃথিবীতে পাখিটির সংখ্যা ১০৮ থেকে ৩০৪। অথচ ২০০৯ সালে এই পাখির সংখ্যা ছিল ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০। বুনো অবস্থায় বাঘের সংখ্যা সারা পৃথিবীতে এখন ৪ হাজার ৫০০টির ওপর। কাজেই একটু কল্পনা করলেই পাখিটি কতটা বিরল তা আঁচ করা যায়।

আমাদের সুন্দরবনেই সুন্দরী হাঁসের সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি। পাখি গবেষক বন্ধু সায়েম ইউ চৌধুরীর এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সুন্দরবনে ৮০ থেকে ১৬৬টি সুন্দরী হাঁস টিকে আছে। এর পরই বেশি সংখ্যক দেখা যায় মিয়ানমার, লাওস ও কম্বোডিয়ায়। তবে অধিকাংশ দেশেই ২০টির বেশি নয়।

গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের সুন্দরবন আর কম্বোডিয়ার তিনটি অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও এ পাখির প্রজননের তথ্য নেই। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো কম্বোডিয়ার বাদাবনে এই পাখির উপস্থিতি নেই। একসময় এই পাখি মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডেও প্রজনন করত। এখন আর নেই। সাম্প্রতিক জরিপ বলছে—ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের বুনো পরিবেশ থেকে পাখিটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বললেই চলে।

বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশই সুন্দরী হাঁসের এখন শেষ আশ্রয়স্থল। ভারতের সুন্দরবন অংশে পাখিটি দেখার কোনো তথ্য নেই। তবে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে এই পাখির উপস্থিতি আছে, তা–ও আবার সংখ্যায় ৫–এর নিচে। গোটা দুনিয়ায় এই প্রজাতির প্রজননক্ষম পাখি টিকে আছে মাত্র ২৫০টির নিচে। ঠিক এ কারণেই পাখিটি এখন মহাবিপন্ন। এখনই এই পাখি সংরক্ষণের পরিকল্পনা না করলে প্রকৃতি থেকে দ্রুতই হারিয়ে যাবে।

আবাসস্থল–সংকটই সুন্দরী হাঁসের হারিয়ে যাওয়ায় প্রধান কারণ হিসেবে গবেষকেরা বলছেন। আমাদের সুন্দরবনে মূল সমস্যা হলো চারপাতা জাল। এ জাল দিয়ে মাছ ধরার সময় এ পাখির বাসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জেলেরা মাছ ধরার সময় পাখিটির উপস্থিতি টের পেলে খাওয়ার জন্য শিকার করেন। বাসা থেকে ডিমও সংগ্রহ করেন।

সুন্দরবন অঞ্চলের সাধারণ মানুষ পাখিটিকে সুন্দরী হাঁস বললেও এ পাখি কিন্তু হাঁস পরিবারের পাখি নয়। হাঁস থেকে একেবারেই আলাদা পরিবারের। হলদেটে লম্বা ঠোঁট আর সবুজাভ পা দেখে অনেকে এটিকে সুন্দরী হাঁস বলে থাকেন। এত সুন্দর রূপ আর গড়নের পাখি পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়।

গত ২০ বছরে সুন্দরবনে এই পাখি দেখতে বহুবার গিয়েছি। বেশির ভাগ ভ্রমণেই পাখিটির দেখা পাইনি। তবে ২০২২ সালের মে মাসে স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের দেখা পেয়েছি। ছবিও তুলেছি। সাধারণত এক জোড়া পাখি একসঙ্গে পাওয়া খুবই বিরল ঘটনা।

কালামুখ প্যারাপাখি সংরক্ষণের দায়িত্ব এখন বাংলাদেশের ওপর। আমাদের সুন্দরবনে পাখিটিকে এখন রক্ষা করতে না পারলে গোটা পৃথিবী থেকেই হারিয়ে যাবে। সুন্দরবনে পাখিটির টিকে থাকার অনেক জায়গা আছে। কিন্তু নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করতে হবে।

এ বনে অধিকতর খাল জরিপের মাধ৵মে পাখিটির প্রজননকালীন আবাসস্থল চিহ্নিত করতে হবে। আর চিহ্নিত খালগুলোকে তার নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। বিশেষ করে ওই সব খালে মাছ ধরা থেকে জেলেদের বিরত রাখতে হবে।

ছোট মাছ, চিংড়ি, কীটপতঙ্গ ও কাঁকড়া পাখিটির প্রধান খাবার। সুন্দরবনের জলে লবণাক্ততার প্রভাব পড়লে পাখিটির এসব খাবারের ওপরও প্রভাব পড়ে। এরই মধ্যে পাখিটিকে বেশি লবণাক্ত অঞ্চল থেকে কম লবণাক্ত অঞ্চলের দিকে সরে যেতে দেখা যাচ্ছে।

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে বলে গবেষকেরা বলছেন। এখন সুন্দরবনের সবচেয়ে স্বতন্ত্র এই পাখি রক্ষায় সবার এগিয়ে আসা উচিত।

  • সীমান্ত দীপু বন্য প্রাণী গবেষক