শাপলার চুপচাপ সংসার

মৌলভীবাজারের দনাশ্রীর জলাধারে শাপলার হাসি
ছবি: প্রথম আলো

‘বর্ষাকালে আমাদের পুকুরে শাপলা হয়, শীত গ্রীষ্মে এই/ পুকুর সম্পূর্ণ শুশক হয়ে যায় পুকুরের নিচে ঘাস গিজায়, তখন—/ পুকুরে শাপলা আর থাকে না, আবার সেই বর্ষাকাল আসে/ তখন পুকুরটিতে জল জমে পুনরায় শাপলা গজায়।’...কবি বিনয় মজুমদারের কবিতার মতো একটি জলাধারে অনেক বছর ধরে শাপলারা চুপচাপ সংসার সাজিয়ে চলেছে। সবুজ বড়সড় পাতাদের কোল থেকে বেরিয়ে আসে তারা, তখন ফুলে ফুলে লাল হয়ে ওঠে জলাধারটি।

বছরে একবার তারা কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যায়, বাকি সময় জলের শরীর ছুঁয়ে এই শাপলা লাল প্রজাপতি হয়ে থাকে। তারা দূরে দূরে রঙের পাপড়ি খুলে নাচে। এই একটা সময়, যখন তারা তাদেরকে আর নজরেই রাখে না। জানতেও চায় না—কে তাদের দেখল, কে দেখল না। তাদের তো ফুটতেই হয়, ফোটাটাই কাজ।

মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে খুব বেশি দূরের পথ নয়, তিন থেকে চার কিলোমিটারের কাছে এই জল-উদ্যান। ওই জায়গার পাশ ছুঁয়ে একদিন খরস্রোতা মনু নদ বাঁক দিয়ে ছুটে গেছে ভাটির দিকে। সেই পুরোনো নদ প্রবাহের অংশটি এখনো আছে, বদ্ধ অংশটি এখন ‘আনমনু’ নামে পরিচিত। মনু নদের মোচড় খাওয়া বাঁককে কেটে সোজা করে মাতারকাপনে মনু নদের ওপরই তৈরি করা হয়েছে ‘মনু ব্যারাজ’। সেই ব্যারাজ থেকে আধা কিলোমিটার উত্তরে শাপলার সংসার। জায়গাটি পড়েছে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার দনাশ্রীতে।

ওই জলাধারের পাশ দিয়ে গেছে মনু সেচ প্রকল্পের বড় বাঁধটি। এই বাঁধ এখন শাপলা–ফোটা জলাভূমির উত্তর দিকের মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়ক এবং দক্ষিণ দিকের মৌলভীবাজার-শমশেরনগর সড়কের মধ্যে সংযোগ তৈরি করেছে। এ দুটি সড়কের গাড়ি ওই বাঁধের ওপর দিয়েই আসা–যাওয়া করে। এতে প্রতিদিন প্রচুর গাড়ি চলে এই পথে। এ পথের যাত্রীদের চোখের সামনে হঠাৎ রঙিন ভুবনের মতো দুলে ওঠে ছোট-বড় শাপলার ভাই-বোনেরা।

জলাভূমির প্রতিবেশী সৈয়দ ইউছুফ আলী জানান, প্রায় ১২ বছর ধরে এখানে শাপলা ফুটছে। ওখানে মাছের দুটি খামার আছে। মাছের সঙ্গে এই ফুলও আছে। ফুল কেউ ধ্বংস করে না। শাপলারা নিজেদের মতো কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যায়, আবার বর্ষা এলে ফুটতে থাকে। তারপর অনেক দিন চলে লাল শাপলার সংসার। প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে। ঘুরে ঘুরে ফুল দেখে। ছবি তোলে। শারদীয় দুর্গাপূজা, বিষহরি পূজায় স্থানীয় ও আশপাশের সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকজন এখান থেকে পূজার উপকরণ হিসেবে শাপলা কুড়িয়ে নেন। অনেক দূর থেকেও অনেকে পূজার ফুল নিতে আসেন।

হ্রদের মতো এই জলাধারের পশ্চিমে কিছু ধানখেত। পাশেই মানুষের ঘরবাড়ি। পূর্ব দিকে মনু সেচ প্রকল্পের বাঁধ। সেই সড়ক দিয়ে গাড়ি চলছে। স্বচ্ছ জলের বুকে ভেসে আছে সবুজ পাতারা, হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছে। মা পাখির পালকের মতো সেই পাতার নিরাপদ প্রশ্রয় থেকে মাথা তুলছে শাপলা ফুল। কোথাও একসঙ্গে অনেকটা, কোথাও একা, কোথাও কয়েকটি মিলে। কিছুটা বিনয় মজুমদারের কবিতার মতোই, ‘এবং পুকুরটিও চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল, পুকুরের আনন্দ বেদনা/ পাতা হয়ে ফুল হয়ে ফুটে ওঠে পৃথিবীতে, এই বিশ্বলোকে।/ শাপলার ফুলে ফুলে পাতায় কখনো মিল থাকে, মিল কখনো থাকে না।’

এই মিল থাকা না থাকার বোঝাপড়ার মধ্যেই লাল-সবুজের ঐক্য এখন দনাশ্রীর জলাধারের বুকে। সারাটা রাত ধরেই শাপলারা আলোর কাছে, ভোরের কাছে আসবে বলে একটু একটু করে চোখের পাতার মতো সব পাপড়ি খোলে। সকালবেলা সেই ঢুলুঢুলু ঘুমের সতেজ মগ্নতা পাপড়িজুড়ে। কোমল হাওয়া, হালকা বৃষ্টির ফোঁটার আদরে কাতর ফুলদল মৃদু দুলতে থাকে।

মাছের ঘাইয়ে কাঁপে পাতাদের ঘুমভাঙা শরীর। এদিক-ওদিক দু–চারটে সাদা বক, দু-একটা পানকৌড়ি, ফিঙে ধ্যানে বসে। কখনো উড়াল দিয়ে এদিক-ওদিক যায়। আধা কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কাছাকাছি হ্রদের মতো এই জলাধারজুড়ে আর কিছু নেই, টলটলে অথই জলের বুকে মন রাঙানোর মতো শুধুই শাপলার ঢেউ, শাপলার হাসি, নির্বিরোধ সংসার। তাদের পাণ্ডুলিপিতে নিঃস্ব হওয়া বলে কিছু নেই, আছে ফোটার আনন্দ।