বৈরী প্রকৃতির বুকে মধু গেছে কমে

বেশি কুয়াশা থাকলে ও বৃষ্টি হলে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করতে বের হয় না। দীর্ঘ তাপপ্রবাহে ফুলের রস শুকিয়ে যায়।

সম্প্রতি প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা, তখন বৃষ্টির দেখা নেই। আবার যখন বৃষ্টির মৌসুম নয়, তখন অতিবৃষ্টিতে ডুবছে চরাচর। গরমকালে অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহে মানুষের ত্রাহি দশা। বিরূপ এই আবহাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মধু উৎপাদনে। গত অর্থবছরে দেশে মধুর উৎপাদন কম হয়েছে। চলতি বছরও মধুর উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

মধুচাষি, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন তাপ, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি ও কুয়াশা অস্বাভাবিক আচরণ করছে, যা মধু উৎপাদনকে ব্যাহত করছে। শীতে বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টিতে ফুল থেকে মধুর উপকরণ (নেকটার) ঝরে যায়। বেশি কুয়াশা থাকলে ও বৃষ্টি হলে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করতে বের হয় না। দীর্ঘ তাপপ্রবাহে ফুলের রস শুকিয়ে যায়। পাশাপাশি সংকটকালীন খাদ্যের অভাবে এবং গরমে রোগ বাড়ায় মৌমাছির মধু সংগ্রহের সক্ষমতা কমছে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে মধু উৎপাদন বাড়ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ১০ হাজার ৬৫৫ মেট্রিক টন মধু উৎপাদন করা হয়, যা গত ১১ বছরের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। কিন্তু তার পরের বছর (২০২২-২৩) মধু উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৩২৮ মেট্রিক টনে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মধু উৎপাদন ৩১ শতাংশ কমে গেছে।

বিশেষজ্ঞ, বিসিক কর্মকর্তা ও খামারিরা বলছেন, মধু উৎপাদন প্রকৃতি বা আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মধু উৎপাদন কমেছে। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও একই ধরনের বিরূপ আবহাওয়া ছিল। ফলে এই অর্থবছরও মধু উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলঙ্গার মধুচাষি শিশির কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২১-২২ অর্থবছর যত মৌমাছি দিয়ে যে পরিমাণ মধু পেয়েছিলাম, পরের বছর তার চেয়েও বেশি মৌমাছি নিয়ে কম মধু পেয়েছি।’ এবারও আবহাওয়া অনুকূলে নয়, উল্লেখ করে শিশির কুমার বলেন, এই লিচুর মৌসুমে নাটোর-রাজশাহী-পাবনা অঞ্চল বৃষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে তাপপ্রবাহে লিচুর ফুল লাল হয়ে যায়, রস কম ছিল।

বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিক ছয়টি কেন্দ্রে মধু উৎপাদন করে। পাশাপাশি তারা মৌমাছি চাষের প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে। আর এসব বিষয় দেখাশোনা করে বিসিকের উন্নয়ন বিভাগ। এই বিভাগের দায়িত্বশীল উপব্যবস্থাপক আমিনা খাতুনও মনে করেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে মধু উৎপাদন কমেছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মধু উৎপাদন হয় শর্ষে ফুল থেকে। শর্ষের সময় নিম্নচাপ ছিল, বৃষ্টিও ছিল। গতবার এই সমস্যা ছিল, এবারও এ ধরনের সমস্যা দেখা গেছে।’

মধু উৎপাদন কমার কারণ

মৌমাছি ফুল থেকে রস (নেকটার) সংগ্রহ করে এবং তা মধুতে রূপান্তরিত হয়। দেশে মধু উৎপাদনের প্রধানত তিনটি মৌসুম—শর্ষে, লিচু ও ধনে-কালিজিরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মধু উৎপাদিত হয় শর্ষের মৌসুমে, পরে লিচুর মৌসুমে। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে জানুয়ারিজুড়ে শর্ষের ফুল থাকে। ফেব্রুয়ারি মাসের পুরো সময়টায় ধনে-কালিজিরার ফুল হয়। ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে মার্চজুড়ে থাকে লিচুর ফুল।

২০২২-২৩ অর্থবছরে মধু উৎপাদন কম হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিসিক কুমিল্লার মৌমাছি পালন কর্মসূচির সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুনায়েম ওয়ায়েছ প্রথম আলোকে বলেন, নভেম্বরের শেষ দিক থেকে জানুয়ারির পুরোটা সময় ধরে শর্ষে থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌমাছি। ২০২২ সালে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে নদী অববাহিকায় অনেক কুয়াশা দেখা দেয়। ডিসেম্বরে সাধারণত বৃষ্টি না হলেও ওই বছরের ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি হয়। তখন কিছু জায়গায় শিলাবৃষ্টিও হয়। পরে ২০২৩ সালের ২ থেকে ৬ জানুয়ারি অনেক কুয়াশা ছিল। ১৫ থেকে ২২ জানুয়ারি শৈত্যপ্রবাহ হয়। এই দীর্ঘ সময় আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না।

আবার ২০২৩ সালের ১৫ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত বৃষ্টি ছিল। ওই সময় লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহের উপযুক্ত সময় ছিল। বৃষ্টির কারণে ওই বছর লিচু মৌসুমে গাছে ফুল থাকলেও মধু কম সংগ্রহ হয়েছিল বলেও জানান মুনায়েম ওয়ায়েছ। আবার দীর্ঘ তাপপ্রবাহে এবার লিচুর ফুল লাল হয়ে যাওয়ায় মৌমাছি রস কম সংগ্রহ করেছে বলেও জানান কর্মকর্তারা।

আবহাওয়ার বিরূপ আচরণে দেশে মধু উৎপাদন কমেছে বলে মনে করেন মৌমাছি–বিশেষজ্ঞ রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেনও। পাশাপাশি তিনি ক্রান্তিকালীন (যখন প্রকৃতিতে ফুল কম থাকে) মৌমাছির খাদ্যের অভাব ও রোগের প্রাদুর্ভাবকেও মধু উৎপাদন কমার জন্য দায়ী মনে করেন।

মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়মিত বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। আবার তাপমাত্রা বাড়ার কারণে মৌমাছির মধ্যে লার্ভা পচা রোগের সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে; বিশেষ করে নাটোর, পাবনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে। চিনির দাম বাড়ায় ক্রান্তিকালীন চাষিরা মৌমাছিকে যথেষ্ট খাবার দিতে পারেন না। এতে খাদ্যাভাবে মৌমাছির স্বাস্থ্য দুর্বল হয়। অসুস্থ, দুর্বল থাকলে মৌমাছি মধু কম সংগ্রহ করে।

লিচু, বরই, আমের মতো বিভিন্ন ফসলের বৃদ্ধিতে ফুলের উৎস বাড়ছে বলেও মনে করেন মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন। তিনি বলেন, ফুলের উৎস বাড়লে ও মৌমাছির স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে মধু উৎপাদন বাড়বে।