নদী কমিশন ও ঢাকা ওয়াসার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

দূষণের জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দায়ী করেছিলেন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান। চিঠি দিয়ে ওয়াসা বলেছে, তাঁর বক্তব্য অপেশাদার।

দখল ও দূষণে ক্ষয়িষ্ণু বুড়িগঙ্গা
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঢাকার চারপাশের চার নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগের দূষণ নিয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এবং ঢাকা ওয়াসার মধ্যে অভিযোগ ও নালিশ জানানোর ঘটনা ঘটেছে।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী নদীদূষণের জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দায়ী করে এক মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। ঢাকা ওয়াসা নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে বলেছে, তিনি একটি দায়িত্বশীল পদে থেকে অপেশাদার বক্তব্য দিতে পারেন না।

সূত্র জানিয়েছে, কমিশনের চেয়ারম্যান ঢাকা ওয়াসার চিঠির বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানিয়েছেন। চিঠিতে তিনি বলেছেন, ঢাকা ওয়াসা নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানকে এ ধরনের চিঠি দিতে পারে না। এটি অসৌজন্যমূলক।

যারা নদী দূষণ করে, তাদের মধ্যে ঢাকা ওয়াসা অন্যতম। এর সঙ্গে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরাও কম দায়ী নন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বেলা

কমিশনের চেয়ারম্যান দূষণের জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দায়ী করেছিলেন গত ১৮ মে এক মতবিনিময় সভায়। ঢাকার চারপাশের চারটি নদীর দূষণ কমাতে করণীয় ঠিক করতে নদী রক্ষা কমিশন এ সভার আয়োজন করেছিল। এতে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় কার্যবিবরণী থেকে ঢাকা ওয়াসাকে দায়ী করার বিষয়টি জানা যায়। সভায় কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ঢাকার নদী ও খালদূষণের জন্য যদি কোনো প্রতিষ্ঠানকে এককভাবে দায়ী করতে হয়, সেটি হচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। তারা প্রয়োজনীয় পয়োনিষ্কাশন লাইন স্থাপন করে না। বাড়িঘরের পয়োবর্জ্যের সংযোগ পানিনিষ্কাশনের লাইনের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে।

সভায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ শিহাবুর রহমান। সূত্র জানায়, সভার পর ঢাকা ওয়াসা থেকে চিঠিটি দেওয়া হয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানকে। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক বলেন, এটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিষয়। এ বিষয়ে তাঁর কোনো বক্তব্য নেই।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসা থেকে একটি চিঠি এসেছে। বিষয়টি আমার পছন্দ হয়নি। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তা জানিয়েছি।’

ঢাকার চারপাশের চারটি নদীর দূষণ কমাতে করণীয় ঠিক করতে নদী রক্ষা কমিশন এ সভার আয়োজন করেছিল। এতে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ও ইউনিসেফের স্যানিটেশন পরামর্শক মুজিবুর রহমানের ২০২১ সালের একটি গবেষণাপত্রে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে দৈনিক ৯১ কোটি লিটার পয়োবর্জ্য উৎপন্ন হয়।

ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ দাবি করে, ঢাকার ২০ ভাগ পয়োবর্জ্য শোধন করা হচ্ছে। বাস্তবে রাজধানীর ২ ভাগের কম পয়োবর্জ্য পরিশোধন হচ্ছে। বাকি বর্জ্য চলে যায় খাল ও নদীতে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, যারা নদী দূষণ করে, তাদের মধ্যে ঢাকা ওয়াসা অন্যতম। এর সঙ্গে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরাও কম দায়ী নন। তবে সরকার বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নৈতিক অধিকার রাখে না। কারণ, সরকার নিজেই নদী দূষণ করছে।

ঢাকা ওয়াসা থেকে একটি চিঠি এসেছে। বিষয়টি আমার পছন্দ হয়নি। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তা জানিয়েছি
নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী

আরও সরকারি সংস্থা দায়ী

কার্যবিবরণী অনুযায়ী নদী রক্ষা কমিশন আয়োজিত মতবিনিময় সভায় নদী দূষণ রোধে ব্যর্থতার জন্য সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এবং পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থাকে দায়ী করা হয়।

উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, ২০০৯ সালে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। গত এক যুগে চারটি নদীর দূষণ কমাতে পরিবেশ অধিদপ্তর উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোনিয়া সুলতানা বলেন, তাঁরা ২৪ ঘণ্টা দূষণকারী কারখানাগুলোকে নজরদারিতে রাখতে পারেন না। পরিদর্শনে গেলে বর্জ্য পরিশোধনাগার চালু রাখা হয়। ফিরে এলেই তা বন্ধ রাখা হয়।

কী সিদ্ধান্ত

সভায় সভায় বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার চারপাশের চারটি নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ১১টি খালের দূষিত পানি যাতে নদীতে না পড়তে পারে, সে জন্য প্রতিটি খালের প্রান্তে পরিশোধনাগার স্থাপন করা হবে, ঢাকা ওয়াসার যেসব আউটলেট নদীতে উন্মুক্ত, সেখানে পয়োনিষ্কাশন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) বসাতে হবে এবং শিল্পকারখানায় বর্জ্য শোধানাগার স্থাপন করতে হবে ও তা চালাতে হবে।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আগামী বছরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনের আগে চারটি নদীর দূষণ বন্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করছি।’