শালবনের সহচর বিজু ফুল

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শালবনে ফুটেছে গোলাপি বিজু ফুলছবি: লেখক

সময়টা যখন বিজু উৎসবের, তখন বিজু ফুল ফুটবে না, তা তো হতে পারে না। বিজু হলো চাকমাদের এক অন্যতম প্রধান আনন্দ উৎসব। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও পয়লা বৈশাখের দিন মিলে তাঁরা এ উৎসব উদ্‌যাপন করেন, যার প্রধান উপকরণ ফুল। ভোরের আলো ফোটার আগেই চাকমা ছেলেমেয়েরা ফুল সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়ে। এ সময় দেখা মেলে অনেক ফুলের। সংগ্রহের পর সে ফুলগুলোকে তারা তিন ভাগ করে। এক ভাগ দিয়ে ভগবান বুদ্ধের পূজা করে আর এক ভাগ জলে ভাসিয়ে দেয় ও অন্য ভাগের ফুলগুলো দিয়ে ঘরবাড়ি সাজায়। খোঁপায় ফুল গোঁজা বা জলে ভাসিয়ে দেওয়া, ফুলদানিতে রাখা—কোথায় না সুন্দর এ ফুল!

চৈত্রের শেষ দিন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের উদ্ভিদ গবেষক ও নিসর্গী মো. আব্দুর রহিমের আমন্ত্রণে সেখানে পৌঁছে গেলাম সকালেই। প্রথমেই তিনি ড. ওয়াজেদ মিয়া গবেষণাকেন্দ্রের সামনে রাস্তার উল্টো পাশে নিয়ে গেলেন বিজু ফুল দেখাবেন বলে। বললেন, ‘ওখানে কয়েক ঝোপ বিজু ফুলের গাছ আছে, কয়েক দিন আগে সাদা বিজু ফুল ফুটতে দেখেছিলাম সেখানে।’

টিনের বেড়া দিয়ে জায়গাটা ঘিরে ফেলা হয়েছে। একটা ফাঁক গলিয়ে দুজন সেখানে ঢুকে পড়লাম। রাস্তার ঢালে কয়েক ঝোপ বিজু ফুলের গাছ ও নিচু জায়গায় দাঁতরাঙার ঝোপ। কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হলাম, কোনো ফুল নেই, সব ফুটে ঝরে গেছে। রহিম ভাই ভরসা দিয়ে বললেন, ‘এখানে নেই তো কী হয়েছে, আমাদের সুন্দর বনে আছে, চলেন সেখানে যাই।’

সুন্দর বন! সেটা আবার কোথায়? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক যে বনটুকু আছে, সেটাই এখানে এ নামে পরিচিত। সে বনে গিয়ে পেলাম শাল, সেগুন, মুচকুন্দ, আনই, কুমারীলতা, ভুঁইচাঁপা, বাজনাগাছের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা বহু বিজু ফুলের গাছ। কিন্তু সেখানেও ফুলগুলো মলিন, শেষের পথে। বনের আরও ভেতরে ঢুকে অবশেষে দেখা পেলাম সেই সতেজ বিজু সুন্দরীদের। প্রথমে সাদা বিজু ফুলের, পরে পেলাম গোলাপি-সাদার দেখা। সে দিনেই মনে হয় ফুটেছে। সাদা ফুলগুলো থেকে চমৎকার ঘ্রাণ আসছে, গোলাপি ফুলগুলোর ঘ্রাণ সাদা ফুলগুলোর চেয়ে কম। গুল্ম প্রকৃতির অনুচ্চ গাছ, ঝোপ করে আছে। জড়াজড়ি করে আছে শালগাছগুলোর সঙ্গে। পাতা বেশ বড়, রঙ্গনের মতো কিছুটা দেখতে। ফুলও পলকজুঁই ও শ্বেতরঙ্গনের মতো। তবে ফুল খুবই ছোট, ফুলনল অনেক লম্বা ও সরু কাঠির মতো। একটা থোকায় শত শত ফুল, হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে যেন আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে।

বিজু ফুলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Ixora cuneifolia ও গোত্র রুবিয়েসি। অর্থাৎ এরা রঙ্গনের সহোদর, রঙ্গনের ইক্সোরা মহাজাতির গাছ সারা পৃথিবীতে আছে ৫৩০ থেকে ৫৭৬ প্রজাতির, এগুলোর মধ্যে এটি একটি প্রজাতি। তবে রঙ্গনের মতো লালিত নয়। এ জন্য একে বনরঙ্গনও বলা যায়। তবে বইপত্রে এর বাংলা নাম বেওফুল, বিজু ফুল এর স্থানীয় নাম। সাধারণত শালবনের ভেতরে জন্মে, বুনো গাছ। কিন্তু চৈত্র মাসে এসব জংলি গাছে যে অসাধারণ ফুল ফোটে, তাতে ওকে বাগানে ঠাঁই দিতেও মনে হয় কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু কথা হলো সে তাদের সঙ্গে বন থেকে বাগানে যেতে চাইবে কি না বা সেখানে গিয়ে কতটা ভালো থাকবে।

বিজু ফুল গুল্ম প্রকৃতির চিরসবুজ গাছ। বাঁচে অনেক বছর। গাছ প্রায় দেড় মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়, ছড়ানো ডালপালা। পাতা উপবৃত্তাকার, লম্বা ও আগা সুচালো। ডালের আগায় থোকা ধরে ফুল ফোটে বসন্তকালে। ফুলের পাপড়ি চারটি, ফুল ঝরে যাওয়ার পর রঙ্গনের মতোই ছোট মটর দানাসদৃশ ফল হয় থোকায়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলে ফুল ফোটে, ফল পাকে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরে, ফল পাকলে হয় লাল। ফলের ভেতরে এক-দুটি বীজ থাকে, বীজ থেকে চারা হয়। আদিনিবাস ইন্দো-চীন অঞ্চল।

বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গে বিজু ফুলের গাছ দেখা যায়। কোনো কোনো গবেষক বিজু ফুলকে ঢাকা জেলার আদি গাছ হিসেবে দাবি করে বলেছেন, এর আসল জন্মস্থান ঢাকা অঞ্চলের শালবন। সে হিসেবে সাভারের বিক্ষিপ্ত শালবনে এর কয়েকটা জাতের দেখা পাওয়া মোটেও বিচিত্র নয়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়ামের গবেষকেরা এ গাছের দেখা পেয়েছেন রাঙামাটির রামপাহাড়েও। আমাদের দেশি গাছ হলে এ নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা হতে পারে, জানা যেতে পারে এর ঔষধি গুণ ও জাতিতাত্ত্বিক লোকজ ব্যবহারের কথাও।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক