এবারের মে ৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত

ঢাকায় বায়ুদূষণের স্থানীয় যেসব উৎস আছে, সেগুলো বন্ধ করার আহ্বান।

দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকার নাম বারবার উঠে আসছে
ফাইল ছবি

চলতি বছরের মে মাসের ঢাকার বায়ুদূষণ এর আগের সাত বছরের মে মাসগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। এবারের মে মাসের দূষণের গড় মান আগের বছরগুলোর তুলনায় প্রায় ২৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। আর গত বছরের (২০২২) তুলনায় তা বেড়েছে ৪ শতাংশের বেশি। গত মে মাসে রাজধানীবাসী যত দিন অস্বাস্থ্যকর বায়ুর মধ্যে কাটিয়েছেন, আগের সাত বছরে তা হয়নি।

আট বছরের দূষণের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানিয়েছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের বায়ুমান সূচক বা একিউআই বিশ্লেষণ করেছেন ক্যাপসের গবেষকেরা।

আরও পড়ুন

‘ভালো’ মানের বায়ুর ক্ষেত্রে একিউআই স্কোর শূন্য থেকে ৫০। ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে ‘মধ্যম’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তাকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। আর ৩০১ থেকে ওপরের স্কোর ‘ঝুঁকিপূর্ণ’।

এ বছর এপ্রিল ও মে মাসে বৃষ্টি কম হয়েছে। তাই এই বায়ু (দূষিত বায়ুপ্রবাহ) এ দুই মাসেও এসেছে। তবে স্থানীয় যেসব উৎস আছে, সেগুলোর বড় ভূমিকা আছে। এগুলোকে বন্ধ করতে হবে, কিন্তু তা দেখছি না।
আবদুস সালাম, অধ্যাপক , রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

ক্যাপসের গবেষণা অনুযায়ী, গত সাত বছরে মে মাসে বায়ুর গড় মান ১২২ দশমিক ২৯। ২০১৬ সালে মে মাসে ঢাকার বায়ুমান সূচক গড়ে ১২৩ ছিল। এরপরের বছরগুলোতে গড় মান বাড়া-কমার মধ্যে থেকেছে। ২০২১ সালে এটি ছিল ১১৪। আর ২০২২ সালের বায়ুমান সূচক আগের তুলনায় বেড়ে গিয়ে গড়ে ১৪৪–এ এসে দাঁড়ায়। আর চলতি ২০২৩ সালের মে মাসে বায়ুমান সূচক আরও বেড়ে গিয়ে ১৫০ দশমিক ৩৬–এ এসে দাঁড়িয়েছে।

ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু মে মাস নয়, আমরা দেখেছি, গত এপ্রিল মাসের বায়ুদূষণও এর আগের সাত বছরের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এখন শুষ্ক মৌসুম ছাড়াও অন্য মাসগুলোতে দূষণ বাড়ছে। এটা নগরবাসী ও জনস্বাস্থ্যের জন্য সুখকর নয়।’

আরও পড়ুন

এ বছরের মে মাসে ১৬ দিন অস্বাস্থ্যকর ছিল ঢাকার বায়ু। আগের বছর ২০২২ সালের মে মাসে এ সংখ্যা ছিল ১৩ দিন। আর তার আগের বছর (২০২১) ছিল ৫ দিন।

গত আট বছরের মে মাসে মোট অস্বাস্থ্যকর বায়ু ছিল ৪৬ দিন। এর মধ্যে এবারের মে মাসেই ছিল ১৬ দিন। আর এ মাসে মাত্র ১ দিন বায়ু ভালো ছিল।

ক্যাপসের দেওয়া উপাত্তের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মোতালিবের কথা, বাংলাদেশের বায়ুদূষণে উপমহাদেশীয় বায়ুপ্রবাহের একটা ভূমিকা আছে। এপ্রিল মাসেই এমন একটি বায়ুপ্রবাহ ছিল। ক্যাপসের গবেষণায় কি সেই বিষয়গুলো আসে? এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে শুধু দূষণের কথা বলা বিজ্ঞানসম্মত নয়।

শুধু মে মাস নয়, আমরা দেখেছি, গত এপ্রিল মাসের বায়ুদূষণও এর আগের সাত বছরের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এখন শুষ্ক মৌসুম ছাড়াও অন্য মাসগুলোতে দূষণ বাড়ছে। এটা নগরবাসী ও জনস্বাস্থ্যের জন্য সুখকর নয়।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার

আবদুল মোতালিব যে উপমহাদেশীয় বায়ুপ্রবাহের কথা বললেন, বিশ্বব্যাংকের গবেষণায়ও ঢাকার বায়ুদূষণে সেটির ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। ‘নির্মল বায়ুর জন্য চেষ্টা: দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের ওপর দিয়ে একই মেঘমালা উড়ে যায়।

ওই মেঘের মধ্যে দূষিত বায়ু গিয়েও আশ্রয় নিচ্ছে, যা এই দেশগুলোতে দূষিত বায়ু ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বের দূষিত বায়ুর শীর্ষ ১০টি শহরের ৯টি দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত। ঢাকা শহর এর মধ্যে অন্যতম। ঢাকার দূষিত বায়ুর ৩০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তবে ঢাকার বাইরের শহরগুলো থেকেও ৪০ শতাংশ দূষিত বায়ু প্রবাহিত হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বায়ুমান গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, ধুলা ও ধোঁয়া ঢাকার বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। এ ধুলার বড় উৎস অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নির্মাণকাজ, পুরোনো যানবাহনের দূষিত বায়ু। আর ৪০ শতাংশ দূষণের উৎস খড়, কাঠ ও তুষের মতো জৈব বস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা।

গবেষণার বিষয়ে ক্যাপসের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, উপমহাদেশীয় দূষিত বায়ুর অনুপ্রবেশ অবশ্যই বিচার্য বিষয়। কিন্তু এর প্রভাব থাকে মূলত শুষ্ক মৌসুমে। অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাসের দিকে। এরপরে এপ্রিল, মে মাসে দূষণের তেমন আধিক্য থাকে না। ঢাকার ক্ষেত্রে তাই দূষণের স্থানীয় উৎসগুলোই বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সেগুলোর মধ্যে পুরোনো গাড়ির ধোঁয়া, নির্মাণকাজের ধুলা, ইটভাটা ও কলকারখানার ধোঁয়া আছে।

ঢাকার দূষণে উপমহাদেশীয় দূষিত বায়ুপ্রবাহকে বিবেচনায় নিতে হবে। এ বছর এপ্রিল ও মে মাসে বৃষ্টি কম হয়েছে। তাই এই বায়ু এ দুই মাসেও এসেছে। তবে স্থানীয় যেসব উৎস আছে, সেগুলোর বড় ভূমিকা আছে। এগুলোকে বন্ধ করতে হবে, কিন্তু তা দেখছি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বায়ুমান গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, ধুলা ও ধোঁয়া ঢাকার বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। এ ধুলার বড় উৎস অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নির্মাণকাজ, পুরোনো যানবাহনের দূষিত বায়ু। আর ৪০ শতাংশ দূষণের উৎস খড়, কাঠ ও তুষের মতো জৈব বস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার দূষণে উপমহাদেশীয় দূষিত বায়ুপ্রবাহকে বিবেচনায় নিতে হবে। এ বছর এপ্রিল ও মে মাসে বৃষ্টি কম হয়েছে। তাই এই বায়ু এ দুই মাসেও এসেছে। তবে স্থানীয় যেসব উৎস আছে, সেগুলোর বড় ভূমিকা আছে। এগুলোকে বন্ধ করতে হবে, কিন্তু তা দেখছি না।’