টেমস থেকে টাঙ্গুয়ায় গঙ্গাকৈতর
২০১৭ সালের মার্চের ঘটনা। ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইন্সপায়ার প্রকল্পের অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্যে এসেছি। প্রকল্পের মূল কাজ নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কাজ শেষে তিন দিনের জন্য লন্ডনে এলাম। হোটেল পিকাডিলিতে থাকার ব্যবস্থা হলো। পিকাডিলি (বর্তমানে দ্য ডিলি লন্ডন) মধ্য লন্ডনের প্রাণকেন্দ্র, ওয়েস্ট এন্ড থিয়েটার ডিস্ট্রিক্টের মাঝখানে, পিকাডিলি সার্কাস ও লিচেস্টার স্কয়ারের একবারে পাশে অবস্থিত, যা হোটেলটিকে শহরের বিনোদন ও সংস্কৃতির স্পন্দিত কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দিয়েছে। ‘রিপলিস বিলিভ ইট অর নট’ এখান থেকে দুই মিনিটের পথ। ট্রাফালগার স্কয়ারও কাছাকাছি। নটিংহাম থেকে অক্সফোর্ড হয়ে লন্ডন আসতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বিশ্বখ্যাত লন্ডন চিড়িয়াখানা। পুরোটা দিন ওখানে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরলাম। শেষ দিন রাতে ফ্লাইট। সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ হোটেলের লবিতে ব্যাগপত্র রেখে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গেলাম।
রাস্তায় টিপ টিপ বৃষ্টি। লন্ডনের এটাই সমস্যা। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎই বৃষ্টি। হাতে সময় কম। মাত্র দেড় ঘণ্টায় অনেকটা দৌড়ে এত বড় জাদুঘরটি দেখলাম। এরপর ২০ পাউন্ডে দোতলা ট্যুরিস্ট বাসের টিকিট কেটে ১২টা থেকে পৌনে ৪টা পর্যন্ত পুরো লন্ডন ঘুরলাম, বিশেষ করে টেমস নদীর আশপাশের জায়গাগুলোয়। টাওয়ার অব লন্ডন, সেন্ট পল ক্যাথেড্রাল, ওয়েস্টমিনস্টার প্যালেস, লন্ডন বিগ ব্যান (ঘড়ি), ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে, লন্ডন আই, কাউন্টি হল কোনোটাই বাদ পড়ল না। বহুদিনের শখ ছিল টেমস নদীর বিভিন্ন ব্রিজ দিয়ে যাব। টাওয়ার ব্রিজ, লন্ডন ব্রিজ, ওয়াটারলু ব্রিজ, ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ—সব কটি দিয়েই গেলাম। ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজের দুই পাশ দিয়ে গেলাম দুবার।
তিনটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে দ্বিতীয়বার ব্রিজ পার হয়ে ওয়েস্টমিনস্টার প্যালেস ও বিগ ব্যান পার হতেই একটি ল্যাম্পপোস্টের ওপর গাঢ় খয়েরি মাথার শ্বেতশুভ্র একটি পাখিকে বসে থাকতে দেখলাম। এর আগে ওকে এই রূপে কখনো দেখিনি। পটাপট পাঁচ-ছয়টা ক্লিক করলাম। প্রায় এক বছর পর ২০১৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দুই দিনের টাঙ্গুয়া মিশন শেষ করে সুনামগঞ্জ ফেরার পথে বউলাই নদীতে লন্ডনে দেখা পাখিটির মতো এক জোড়া পাখিকে পানিতে ভাসতে দেখলাম। শ্বেতশুভ্র পাখিগুলোরও গাঢ় খয়েরি মাথা। ক্যামেরার শাটারে অবিরাম ক্লিক করে গেলাম। পাখিগুলোর কাছাকাছি আসতেই কালো চোখের চারদিকে চমৎকার সাদা রিং চোখে পড়ল। নৌকা ওর একেবারে কাছে না আসা পর্যন্ত সে উড়ল না।
লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার ও টাঙ্গুয়ার বউলাই নদীতে দেখা গাঢ় খয়েরি মাথার শ্বেতশুভ্র পাখিটি এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখি গঙ্গাকৈতর। গঙ্গা কবুতর নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে কালাশির গাংচিল। ইংরেজি নাম ব্ল্যাক-হেডেড গাল। ল্যারিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Larus ridibundus। লন্ডনসহ ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও মধ্য এশিয়ার আবাসিক পাখিটি শীতে বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পরিযায়ী হয়।
প্রাপ্তবয়স্ক গঙ্গাকৈতর লম্বায় ৩৫ থেকে ৩৯ সেন্টিমিটার। ওজনে ২০০ থেকে ৪০০ গ্রাম। দেহের ওপরটা ফ্যাকাশে ধূসর ও নিচটা সাদা। উড়ন্ত অবস্থায় সরু ডানা ও ডানার প্রান্তের সরু কালো পাড় চোখে পড়ে। প্রজননকালে মাথায় গাঢ় খয়েরি ঘোমটা দেখা যায়। অন্য সময় পাখির সাদা গালে গাঢ় ফোঁটা থাকে। চোখের রং গাঢ়। চোখের চারদিকে সাদা বলয় চোখে পড়ে। চঞ্চু সরু ও গাঢ় লাল। পা ও পায়ের পাতাও লাল। স্ত্রী-পুরুষের চেহারায় পার্থক্য নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির মুখমণ্ডলে হালকা দাগছোপ থাকে। ছোট আকার, সরু ডানা, ডানার প্রান্তের সরু কালো পাড়, গাঢ় চোখ এবং সরু চঞ্চুর মাধ্যমে ওদের বদরকৈতর থেকে আলাদা করা যায়।
শীতে দেশের বিভিন্ন জলাভূমিতে ছোট বা বড় ঝাঁকে বিচরণ করে। পানির অল্প ওপর দিয়ে ওড়ে। খাবারের জন্য জেলে নৌকার পিছু নেয়। মাছ, চিংড়ি, প্রাণিদেহের উচ্ছিষ্টাংশ, শামুক, কেঁচো ও কীটপতঙ্গও খায়। সচরাচর উচ্চ স্বরে ‘কা-ইয়েক-কা-ইয়েক---’ শব্দে চেঁচিয়ে ডাকে।
মে থেকে জুনে প্রজননকালে ইউরোপ, সাইবেরিয়া ও চীনের উত্তরাঞ্চলে ছোট ছোট উদ্ভিদের আড়ালে মাটিতে সামান্য খোঁদল করে লতাপাতা দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২ থেকে ৩টি, রং বাদামি ছোপসহ অনুজ্জ্বল সবুজ থেকে ধূসর। ডিম ফোটে ২৩ থেকে ২৬ দিনে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ে পালাক্রমে তা দেয় এবং ছানাদের লালন–পালন করে। ছানারা উড়তে শেখে প্রায় ৩৫ দিনে। আয়ুষ্কাল ৯ থেকে ১০ বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়