ছয়জনের টিমে মারুতি জিপসি গাড়িতে সারিস্কা টাইগার রিজার্ভে ঘুরছি বেঙ্গল টাইগার বা বাংলা বাঘের সন্ধানে। এই সংরক্ষিত এলাকাটি ভারতের রাজস্থানের আলওয়ার জেলায় অবস্থিত। ৮৮১ বর্গকিলোমিটারের বিশাল বনটি কাঁটাওয়ালা শুষ্ক জঙ্গল, শুষ্ক পর্ণমোচী, তৃণভূমি ও পাথুরে পাহাড়ের সমন্বয়ে গঠিত।
একসময় এটি আলওয়ার রাজ্যের শিকারের ক্ষেত্র ছিল, যা ১৯৫৮ সালে বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এখানে ২০টি বেঙ্গল টাইগারের বাস। তবে সারা দিন ধরে বিশাল এ বনের বিভিন্ন স্থান ঘুরে বহু প্রজাতির বন্য প্রাণী ও পাখি দেখলেও বাঘের কোনো চিহ্ন দেখলাম না। বিফল হয়ে জয়পুর শহরে ফিরে এলাম।
পরদিন সকালে জয়পুর থেকে সাওয়াই মধুপুর শহরের দিকে রওনা হলাম। উদ্দেশ্য ওখানকার বিখ্যাত ‘রণথামভোর জাতীয় উদ্যান’-এ রণথামভোরের রাজা বেঙ্গল টাইগারের খোঁজ করা।
এখানকার বাঘেরা এ নামেই পরিচিত। দুপুরে রণথামভোর প্যালেস হোটেলে পৌঁছে ব্যাগপত্র রেখে লাঞ্চ না সেরেই রণথামভোর জাতীয় উদ্যানের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ক্যান্টরে (ছাদখোলা ২০ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ট্রাক) উঠলাম। ফোর হুইল ড্রাইভ জিপ (মারুতি জিপসি) জোগাড় না হওয়ায় ২০ জনের সঙ্গে বাধ্য হয়েই ক্যান্টরে করে পার্কে ঢুকলাম।
ক্যান্টর এগিয়ে চলল। নানা ধরনের পাখি ও প্রাণীর দেখা পাচ্ছি। কিন্তু ছবি তোলায় তেমন মন দিতে পারছি না। এত কষ্ট করে এত দূর এসেও যদি রণথামভোরের রাজার দেখা না পাই, তাহলে এ দুঃখ কোথায় রাখব? ক্যান্টরে ঘুরছি ঘণ্টা দেড়েক হলো। এর মধ্যে রাজার কোনো চিহ্ন পাচ্ছি না।
ধরেই নিয়েছি আজ দেখা হবে না। কাল সকালে জিপসি পাব। কাজেই কালকের অপেক্ষায়ই থাকতে হবে। এমন সময় ফিরতি পথে আসা একটি জিপসির গাইড বলল, বেশ কিছুটা সামনে ওরা বাঘ মামার দেখা পেয়েছে। এটা শোনামাত্রই ড্রাইভার দ্রুত ক্যান্টর ছোটাল। ১৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা জায়গামতো পৌঁছে গেলাম।
প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবনের প্রথম বাঘ মামার দেখা পেয়ে ক্যান্টরের সবাই শিহরিত। ওখানে আরও চার-পাঁচটি ক্যান্টর-জিপসি দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের সামনে একটা ছোট খাল। সেই খালের মাঝে পাথরখণ্ডের ওপর একটি ছোট কুমির বসে আছে। তারপর একচিলতে জমি।
ওখানে তিন-চারটি তিতির খাবার খাচ্ছে। তারও খানিকটা ওপরে শুকনো ঘাসের ওপর রাজকীয় ভঙ্গিতে রণথামভোরের রাজা বসে আছে। যাক, অবশেষে রাজার দেখা পেলাম। জীবনে এই প্রথম বনের খোলা প্রান্তরে সত্যিকারের বুনো বেঙ্গল টাইগার দেখলাম, গত ২৬ বছর সুন্দরবন ঘুরেও যার দেখা পাইনি। তবে সুন্দরবনে না দেখলেও রণথামভোরে বাঘ দেখে আমি তৃপ্ত এ কারণে যে বিশ্বের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার ফলাফলে জিনগতভাবে এ বাঘের সঙ্গেই সুন্দরবনের বাঘের সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া গেছে। যাহোক, বিকেলের হালকা রোদে মনপ্রাণভরে মামার ছবি তুললাম।
পরদিন ভোরে কনকনে শীতে আবারও রণথামভোর জাতীয় উদ্যানে ঢুকলাম। এবার ছয়জনের টিমে ফোর-হুইল ড্রাইভে। মামার খোঁজে ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরির পর একটি পয়েন্টে গিয়ে চার-পাঁচটি জিপসি একত্র হলাম। সবাই বলাবলি করছে আশপাশে কোথাও মামা লুকিয়ে আছে, কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি না। পাশেই একটি পুরোনো একতলা বিল্ডিং।
অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর শেষমেশ বিল্ডিংয়ের ছাদে ওঠার অনুমতি মিলল। ছাদে এরই মধ্যেই ভিড় লেগে গেছে। লম্বা লেন্সের ক্যামেরা হাতে ছাদভর্তি ব্যাঘ্র আলোকচিত্রীদের ভিড় বাড়তে লাগল। শেষ পর্যন্ত বহু কষ্টে ছাদের এক পাশে দাঁড়ানোর মতো একটা জায়গা পেলাম। যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে দেহটাকে যতটা বাইরের দিকে বাঁকানো যায়, ততটা বাঁকিয়ে ১৫০ থেকে ৬০০ মিলিমিটার লেন্স মামার দিকে তাক করলাম।
ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে। সকালের তীক্ষ্ণ¥রোদে মামার ঝলমলে সোনালি-হলুদ বর্ণের ওপর কালো ডোরা চোখে পড়ল। আর যায় কোথায়, শাটারে ক্লিকের বন্যা বয়ে গেল। বাঘটির চাহনি আরও রাজকীয় লাগল! রণথামভোরের মামার চমৎকার সব ছবি তুলে জিপসি চেপে ফিরতি পথ ধরলাম।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণিচিকিৎসা বিশেষজ্ঞ