চার ভুতুমের গপ্পো

রাজস্থানের ভরতপুর পক্ষী–অভয়ারণ্যের বাবলাগাছে ভুমা ভুতুম প্যাঁচা ও ছানাছবি: লেখক

আট বছর আগের কথা। ভ্রমণপিপাসু ও পক্ষী আলোকচিত্রী সাজ্জাদ খানসহ কালেঙ্গা বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্যে এসেছি। ‘নিসর্গ গেস্ট হাউস’ থেকে এক কিলোমিটার দূরে টাওয়ারের সামনে এসে ছোট্ট হ্রদটির পাড় ঘেঁষে হাঁটছি। হঠাৎ একটি বড় কাঠবিড়ালি দেখে সাজ্জাদ দাঁড়িয়ে গেল। আমিও দাঁড়ালাম। ওটির ছবি তুলে কিছুটা সামনে এগোতেই বাঁ দিকে ঘন জঙ্গল পড়ল। বেশ কিছু পুরোনো বড় গাছ সেখানে। গাছগুলোর নিচে দিয়ে সামনে এগোচ্ছি।

আমাদের হাঁটার শব্দে কি না জানি না, আচমকা বড় একটা কিছু বাঁ দিক থেকে উড়ে গিয়ে ডান দিকের বড় গাছটায় বসল। ভূত দেখার মতো ভয় পেলাম যেন! ওটির পেছন পেছন আরেকটি পাখি এল। ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে যেই-না শাটারে ক্লিক করেছি, অমনি একটি উড়াল দিল।

দ্বিতীয়টি ওড়ার আগে তিনটি ক্লিক করলাম। নতুন একটি পাখির ছবি নিয়ে মনের আনন্দে সামনে এগোলাম। প্রথম পাখিটিকে দেখেছিলাম বাগেরহাটের ফকিরহাটের সাতশৈয়া গ্রামে ১৯৯৬ সালে। বছর পাঁচেক আগে দেখলাম মিরপুরের বাংলাদেশ জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। আর সর্বশেষ দেখলাম ২০১৯ সালের এপ্রিলে বগুড়ার শাজাহানপুরের গণ্ডগ্রামে।

এতক্ষণ যেটির গল্প বললাম, সেটি এ দেশের এক দুর্লভ আবাসিক পাখি। সেটি ছাড়াও এর আরও তিন প্রজাতির ভাইয়ের বাস এ দেশে, যেগুলোর প্রতিটিই বিরল। বড় আকারের অদ্ভুত দর্শন এই রাতের শিকারি পাখিগুলো সাধারণভাবে ভুতুম প্যাঁচা নামে পরিচিত। উলুক (স্ট্রিজিফরমেস) বর্গের অন্তর্গত উলুক (স্ট্রিজিডি) গোত্রের পাখিগুলোর মাথা চ্যাপটা ও মুখের সামনের দিকে দুটি বড় বড় চোখ, যা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। চঞ্চু হুকের মতো ও থাবা শক্তিশালী। এরা রাতের আঁধারে নিঃশব্দে উড়ে বেড়ায় ও রহস্যময় শব্দে ডাকে। এ কারণেই এদের নিয়ে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত। বাংলাদেশের ১৬ প্রজাতির প্যাঁচার মধ্যে ৪টিই ভুতুম প্যাঁচা। এই চার ভুতুমকে নিয়েই আজকের গল্প।

১. ভুতুম প্যাঁচা (ব্রাউন ফিশ আউল): ফিচারের শুরুতেই যেটির গল্প বললাম, সেটি ভুতুম প্যাঁচা। হুতুম, কুদুম বা মেছো প্যাঁচা নামেও পরিচিত। দক্ষিণ চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভুটান ও মালদ্বীপ ছাড়া উপমহাদেশের সবখানেই দেখা যায়। দেহের দৈর্ঘ্য ৪৮ থেকে ৬১ সেন্টিমিটার, ওজন ১ দশমিক ১ থেকে ২ দশমিক ৫ কেজি। মিশ্র চিরসবুজ বন, আমবাগান, গ্রামীণ জলাভূমির পাড়সহ পুরো দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত।

২. ভুমা ভুতুম প্যাঁচা (ডাস্কি ইগল-আউল/হর্নড আউল): এই বিরল আবাসিক পাখিটিকে দেশে কখনো না দেখলেও ছানাসহ ভারতের রাজস্থানের ভরতপুর পক্ষী–অভয়ারণ্যে দেখেছি। পশ্চিমবঙ্গে বলে শিঙ্গা প্যাঁচা। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাস করে। দেহের দৈর্ঘ্য ৪৮ থেকে ৫৩ সেন্টিমিটার। পুরো দেশের বনবাদাড় ও গাছপালা বেশি, এমন এলাকায় দেখা যায়।

বগুড়ার শাজাহানপুরের গণ্ডগ্রামের ইউক্যালিপটাসগাছে একটি ভুতুম প্যাঁচা
ছবি: লেখক

৩. খাকি ভুতুম প্যাঁচা (টনি ফিশ আউল): দেশের অতি বিরল আবাসিক পাখিটিকে প্রথম দেখি ইউনিভার্সিটি সায়েন্স মালয়েশিয়ায় একটি কনফারেন্সে গিয়ে পেনাংয়ের বাটারওর্থসে। দেশে এখনো ওটির দেখা পাইনি। বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, ভারত, ভুটান, লাওস, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও চীনে দেখা যায়। দেহের দৈর্ঘ্য ৪৮ থেকে ৫৮ সেন্টিমিটার ও ওজন ১ দশমিক ০৫ থেকে ২ দশমিক ৬৫ কেজি। এরা সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ ও ঢাকা বিভাগের পত্রঝরা বনের বাসিন্দা।

৪. বেলাই ভুতুম প্যাঁচা (বাফি বা মালায় ফিশ-আউল): দেশের ভেতরে বহু চেষ্টা করেও দুর্ভাগ্যবশত বিরল প্যাঁচাটির দেখা পাইনি। তবে সিঙ্গাপুরের বিশ্বখ্যাত জুরং বার্ড পার্কে ২০০৮ সালে দেখেছি। আমাদের সুন্দরবনের আবাসিক পাখিটিকে মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরেও দেখা যায়। দেহের দৈর্ঘ্য ৪০ থেকে ৪৮ সেন্টিমিটার ও ওজন ১ দশমিক ০৩ থেকে ২ দশমিক ১০ কেজি।

সব প্রজাতির ভুতুম প্যাঁচাই একাকী বা জোড়ায় থাকে। দিনে গাছের ঘন পত্রগুচ্ছের আড়ালে ঘুমিয়ে কাটায়। ভোর, গোধূলি ও পূর্ণিমা রাতে সক্রিয় হয়। মূল খাবার মাছ, ব্যাঙ, সরীসৃপ, বড় পোকা ইত্যাদি। তবে স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখিতেও অরুচি নেই। প্রজাতিভেদে নভেম্বর থেকে মে প্রজননকাল। সচরাচর বড় গাছের কোটর, খোঁড়ল বা কাণ্ডের ভাঁজে বাসা বানায়। অন্যান্য শিকারি পাখির পরিত্যক্ত বাসাও ব্যবহার করে। ডিম পাড়ে এক থেকে দুটি, রং ঘিয়ে সাদা বা সাদা। পেঁচি একাই তা দেয়। প্রজাতিভেদে ডিম ফোটে ২৮ থেকে ৩৮ দিনে। আয়ুষ্কাল ৮ থেকে ২৩ বছর।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ